দুটো লিপির সাক্ষ্যেও প্রমাণিত হয় যে খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এদেশে আর্য-প্রভাব দৃঢ় ও গাঢ় হয়ে উঠেছে। এর একটি খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের এবং মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত এবং অপরটি খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের, প্রাপ্তিস্থান নোয়াখালির মিলুয়া গাঁ। এছাড়া বাঙলার বিভিন্নস্থানে প্রাপ্ত কুষাণ আমলের মুদ্রাও আর্যাবর্ত তথা উত্তরভারতের সঙ্গে বাঙলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নিঃসংশয় প্রমাণবাহী। এসব থেকে সহজেই অনুমান করা চলে আর্য ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের পূর্বেই বাঙলা দেশে চালু হয়েছে। আর্যবসতি না থাকলে এ কিছুতেই সম্ভব হত না। সিংহলী মহাবংশ বর্ণিত কাহিনীসূত্রে জানা যায়–খ্রস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বঙ্গে রাজা ও রাজ্য ছিল এতে বাঙলার বর্বরোত্তর যুগের আভাস পাই।
.
০৩. চট্টগ্রাম-আরাকানের জনগোষ্ঠী
বিদ্বানদের মতে অস্ট্রো-এশীয় এবং ভোট-চীন গোত্রীয় মানুষই সম্ভবত চট্টগ্রাম ও তার সংলগ্ন আরাকানের খ্রীস্টপূর্ব যুগের আদি অধিবাসী। আর খ্রীস্টীয় সনের গোড়ার দিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ও বৌদ্ধেরা তাদের উন্নততর ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এসব অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে। এভাবে খাসী ও কুকী চীনাদের সাথে (অস্ট্রো-নেগ্রিটো-দ্রাবিড়-মোঙ্গল-আলপাইনীয়-নর্ডিক মিশ্রণে গঠিত) আর্যজাতির ভাষা ধর্ম ও সংস্কৃতির পরিচয় ঘটে। আরাকানী সূত্রে ১৫ জানা যায়, আরাকানে দশ কিংবা বারো শতকের পূর্বে বর্মী অনুপ্রবেশ ঘটেনি। পক্ষান্তরে উত্তরভারতিক আর্যেরা খ্রীস্টীয় সনের গোড়া থেকেই আরাকানে বসতি নির্মাণ করে। আরাকানে প্রথমে ব্রাহ্মণ্য ও পরে বৌদ্ধপ্রভাব বিস্তৃত হয়। এর পুরোনো রাজধানীর নাম দিন্নাওয়াতী (ধান্যবতী বা তৃণবতী) এবং বেসালি (বৈশালী), চন্দ্রবংশীয় রাজাদের সংস্কৃত ও বিকৃত সংস্কৃত নাম, সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার, আরাকানীদের মাগধী১৬ বলে আত্মপরিচয় দান, বৃষ মূর্তি, ধ্বজ ও লাঞ্ছন প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যপ্রভাবের ও ভারতিক জনবসতির স্বাক্ষর বহন করে। সম্ভবত বিহারের বৈশালী থেকে আগত চন্দ্ররাজা পিতৃভূমের নামানুসারে রাজধানীর নাম বৈশালী রাখেন।১৭ আরাকানের ইতিহাসের আলোকে চট্টগ্রামের পুরোনো ইতিহাসের কাঠামো তৈরি করা সম্ভব। Phayre ও Harvey–র সংযোজিত তালিকায় দেখা যায় চন্দ্রবংশীয়দের রাজত্বকাল সাময়িক ছেদ থাকলেও ১৭৮৫ খ্রীস্টাব্দ অবধি প্রসারিত।
.
০৪. ইতিহাসের দূরাগত ধ্বনি
স্থানীয় কিংবদন্তি সূত্রে জানা যায় মহাভারতিক যুগে কর্ণের পুত্র বিকর্ণ চট্টগ্রামে রাজত্ব করতেন। তার রাজধানী ছিল কাঞ্চন নগর। পটিয়া ও ফটিকছড়ি থানা অঞ্চলে দুটো কাঞ্চনগর আছে, সাতকানিয়া থানায় আছে কাঞ্চনা। এ তিনটেই বিকর্ণের রাজধানীর গৌরব দাবী করে। এছাড়া কিংবদন্তি সূত্রে আর কিছু জানা যায় না।
তিব্বতী সূত্রে জানতে পাই, লামা তারানাথ চট্টগ্রাম পর্যটন করেননি। তিনি ভারতে ও তিব্বতে লোকমুখে শুনে কিংবা ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত কাহিনী ভিত্তি করে চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন। তবু এর মধ্যে কিছু সত্য নিহিত রয়েছে বলে মনে করি। সিংহচন্দ্রের প্রপৌত্র বালচন্দ্রের পৌত্র বিমল চন্দ্রের পুত্র গোপীচন্দ্র (বা গোপচন্দ্র) চট্টগ্রামকেই শাসনকেন্দ্র করেন। তিনিই গোপীচাঁদ-ময়নামতী মানিকচাঁদ গীতিকার নায়ক। জ্বালন্ধরীপা বা হাড়িফা তারই মাতা ময়নামতীর শুরু। এ সময় চট্টগ্রামে তীর্থিক ও বৌদ্ধদের সমান প্রাধান্য ছিল। তাই বৌদ্ধবিহারে ও তীর্থিক মন্দিরে চট্টগ্রাম ছিল আকীর্ণ। তান্ত্রিক মহাযান মতই তখন চট্টগ্রামে চালু ছিল। (পরবর্তীকালে বর্মী-আরাকানী প্রভাবে হীনযান মত প্রাধান্য লাভ করে, আরো পরে হীনযান প্রসূত থেরবাদ চট্টগ্রামী বৌদ্ধদের ধর্ম হয়ে ওঠে।
এই সময় চট্টগ্রামে জ্বালনধারা ছিল। সম্ভবত সীতাকুণ্ড ও বাড়বকুণ্ডই এই জ্বালনধারা বা তপ্তজল ধারা। এ থেকে আমরা দুটো অনুমিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি: এক. সিন্ধুদেশীয় বালপাদ জ্বালন্ধরে বাস করেছিলেন বলে জ্বালন্ধরীপা নামে পরিচিত হন; দুই. জ্বালন্ধর ও সামন্দর (সাম অগ্নি+ অন্দর< অন্তর, অভ্যন্তর) একার্থবোধক হলে আরব ভৌগোলিকদের সামন্দর চট্টগ্রামই।
এমনও অনুমিত হয় যে নালন্দাবিহারের গৌরব ও প্রভাব ম্লান হওয়ার কালে চট্টগ্রামই বৌদ্ধ ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানকার পণ্ডিতবিহারের খ্যাতিও ছিল আন্তর্জাতিক। এই বিহার আধুনিক সীতাকুণ্ড কিংবা চক্রশালায় ছিল বলে লোকশ্রুতি আছে। আদিনাথ-চন্দ্রনাথ শিবও মূলত বৌদ্ধ দেবতা–তা নামেই প্রকাশ।
দশশতকের প্রখ্যাত তান্ত্রিক সিদ্ধ তিলযোগী চট্টগ্রামেরই সন্তান। মগধের প্রধান আচার্য নরতোপা চট্টগ্রামে গিয়ে তিলযোগীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
চট্টগ্রামের ছগল রাজা বিশেষ প্রতাপশালী ছিলেন। তার দাপট বাঙলা থেকে দিল্লী অবধি অনুভূত হত। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ্যবাদী ছিলেন, কিন্তু তার বৌদ্ধ-পরীর প্রভাবে মগধে এবং বৌদ্ধগয়ায় ও নালন্দায় নানা সৎকর্ম করেন। বৌদ্ধপণ্ডিত সারিপুত্রের সাহায্যে তিনি বৌদ্ধগয়ায় বুদ্ধপূজা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। ছগল তারানাথের গ্রন্থ রচনার তিনশ বছর পূর্বে ( চৌদ্দশতকের শেষপাদে) বর্তমান ছিলেন।