জালাল খানের পুত্র, কবি মুহম্মদ খানের পিতৃব্য বিরহিম বা ইব্রাহিম খান চট্টগ্রামে আরাকানী উজির হন (১৫৮৬)। ১৬০৭ সনে Francois pyvard প্যাগানরাজের (আরাকান রাজের) অধীনে চট্টগ্রামে মুসলিম শাসনকর্তা দেখেছেন। ইনি সম্ভবত ইব্রাহিম খান।
কহে ফতে খানে, সখি উপায় আছ নাকি
শ্রীযুক্ত ইব্রাহিম খান
ভব কল্পতরু জানহ আমার
পীর মীর শাহ সুলতান।
এই ইব্রাহিম যদি উজির ইব্রাহিম খান হন, তবে কবি সৈয়দ সুলতান ও তিনি সমসাময়িক ছিলেন। ফতে খানের অপর পদে আলাউল খানের নাম আছে। এতে মনে হয় ফতে খানের পীর ছিলেন সৈয়দ সুলতান। উজির ইব্রাহিম খান ছিলেন ফতে খানের জ্যেষ্ঠ সমসাময়িক অর আলাউল ছিলেন তার প্রায় সমবয়সী। ১৫৮৬-১৬০৭ সনের মধ্যে লায়লী মজনু কাব্যোক্ত নিযাম শাহসুর চট্টগ্রামে আরাকানী শাসনকর্তা ছিলেন বলে ডক্টর যে অনুমান করেছেন, তা যদি মানতে হয় তাহলে উজির হিসেবে ইব্রাহিম খানের স্থিতি অস্বীকার করতে হবে। জালাল খানের বিশ্বাসভঙ্গের পর থেকে আরাকানরাজের পুত্র কিংবা ভ্রাতা চট্টগ্রামে প্রধান শাসকরূপে নিযুক্ত হতে থাকেন। এবং এটি রেওয়াজে পরিণত হয়। ম্যানরিক (১৬২৯-৩৫) বলেন : The principality of Chittagong belonged by hereditary right to the second son. আরাকানরাজ মঙরাজাগী বা মঙইয়াজাগীর মুসলিম নাম ছিল সলিম শাহ (১৫৯৩-১৬১২)। তিনি নিজেকে আরাকান, বাঙলা ও ত্রিপুরার নরপতি বলে অভিহিত করতেন। চট্টগ্রামে তৈরি তাঁর মুদ্রায় আরবি, বর্মী ও নাগরী হরফ উত্তীর্ণ করান।
এ যুগটা চট্টগ্রামে পর্তুগীজ প্রাবাল্যের কাল। পরে বিস্তৃতভাবে পর্তুগীজ ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হবে।
ঝ. ১৬১৬ সালে বাঙলার মুঘল সুবাদার কাসিম খান চট্টগ্রাম বিজয়ে অগ্রসর হন। তিনি নিজে ভুলুয়া অবধি গিয়ে আবদুন নবীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে একটি বাহিনী প্রেরণ করলেন। আবদুন নবী নিযাম-পুরের জমিদারকে বশে এনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আরাকানী সৈন্যেরা বাড়বকুণ্ডের নিকটে কাঠের দুর্গ তৈরি করে তাকে বাধা দিলেন। এ স্থান এখন কাঠগড় নামে পরিচিত। দুই দিন যুদ্ধ হল, মুঘলেরা সুবিধা করতে না পেরে ঢাকার দিকে চলে এল। এ যুদ্ধের বিস্তৃত বর্ণনা মেলে বাহারীস্তান গয়বী গ্রন্থে।
ঞ. ১৬২১ সনে মুঘল সুবাদার ইব্রাহিম খানও চট্টগ্রাম বিজয়ে অগ্রসর হন। তিনি ত্রিপুরা থেকে জঙ্গল পথে (রামগড় পাহাড় হয়ে) এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পথের বন্ধুরতার অভিজ্ঞতা তার ছিল না বলে অভিযানের চেষ্টা ত্যাগ করে তাকে ফিরতে হল। ১৬২৪ সালে শাহজাদা খুরম যখন সুবাদার ইব্রাহিম খানকে হত্যা করে ঢাকা দখল করেন, তখন আরাকানরাজ সুধর্মার সঙ্গে খুরমের মৈত্রী হয় এবং মৈত্রীর নিদর্শনস্বরূপ উপহার বিনিময় হয়। ১৬২৫ সালে বাঙলার সুবাদারের প্ররোচনায় চট্টগ্রামে আরাকানরাজের বিরুদ্ধে সামন্ত-বিদ্রোহ ঘটে। এ বিদ্রোহ দমনে এগিয়ে এলেন। স্বয়ং সুধর্মা রাজা (১৬২২-৩৮)। তিনি চট্টগ্রামে বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করে ভুলুয়ায় হানা দেন (১৬২৬) এবং আরো এগিয়ে গিয়ে দোলাই খাল বেয়ে খিজিরপুর ও ঢাকা লুণ্ঠন করে বহু ধন-রত্ন ও বন্দী নিয়ে ফিরে যান। সুবাদার মহব্বত খান কিংবা তার সন্তান খান জাদ খান কোনো বাধাই দিতে পারলেন না (Campos)। ভুলুয়ার থানাদার মির্জা বুগীস ৭০০ অশ্বারোহী ৩০০ রণতরী নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ফল হয়নি।
ট. ১৬৩৮ সালে চট্টগ্রামস্থ আরাকানী শাসনকর্তা মুকুটরায় (Magat Re–সেনাপতি, ফিল্ড মার্শাল) আরাকানরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। লোকশ্রুতি এই যে, মুকুটরায়ের পিতা গৌড়েশ্বর রায়ের নিবাস ছিল খণ্ডল পরগনায়। তিনি নাকি চট্টগ্রাম অধিকারের ব্যাপারে ত্রিপুরা রাজের বিরুদ্ধে আরাকানরাজকে সাহায্য করেন এবং চট্টগ্রামের কদুরখিল গায়ে বসতি নির্মাণ করেন। অপর মতে, সুধর্মা রাজার মৃত্যুর পর তার রাণির প্রেমিক নরপতিণি যখন সিংহাসন দখল করেন, তখন চট্টগ্রামের আরকানী শাসক Magat Re বিদ্রোহী হন। Magat Re আরাকানে হানা দেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ভুলুয়ার মুঘল থানাদারের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর পিছু নিয়ে আরাকানী সৈন্যেরাও যুগদিয়া অবধি অগ্রসর হয়। এখানে সুবাদার ইসলাম খান মসৌদির নৌবাহিনীর সঙ্গে আরাকানীদের যুদ্ধ হয়। আরাকানীরা এ যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। কিছুকাল পরে পর্তুগীজদের প্ররোচিত করে এবং নিজেও সর্বপ্রকার সহায়তা দিয়ে আরাকানরাজ মুঘল শাসিত বাঙলার নানাস্থানে মানুষ ও ধনসম্পদ লুট করাতে লাগলেন। ইসলাম খানের সঙ্গে আরাকানরাজের নৌযুদ্ধও হয়। মুঘলেরা মগ হার্মাদের ধ্বংসকার্য প্রতিরোধ করতে পারেনি। ১৬৬৫ সাল অবধি জলপথে বাঙলা দেশের সর্বত্র অবাধে পীড়ন ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। এরা। ১৬৬৫ সালের পরেও মগ-ফিরিঙ্গী দস্যুদের হামলা বন্ধ হয়নি, তবে কমে ছিল।
ঠ. আওরঙজীব কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে সুজা আরাকান-রাজের আশ্রয় গ্রহণ করেন (১৬৬০)। তরুণ রাজা চন্দ্র সুধর্মা সুজা-কন্যার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অভিজাত ও মুসলমান সুজা সে-প্রস্তাব চরম অবজ্ঞায় প্রত্যাখ্যান করলে রূপমুগ্ধ, অপমানিত রাজা সুজার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেন। তিনি সুজাকে দেশত্যাগের ইঙ্গিত দেন, কিন্তু মক্কা পাঠাবার জন্যে প্রতিশ্রুত নৌকা দিতে অসম্মত হন। সুজা আসন্ন বিপদের শঙ্কায় মরিয়া হয়ে উঠলেন এবং আরাকানী মুসলমান ও বাঙালিদের নিয়ে তিনি আরাকান সিংহাসন দখলে প্রয়াসী হন। যথাসময়ে চন্দ্র সুধর্মা এ খবর পেয়ে সানুচর সুজাকে আক্রমণ করেন। সুজা পালিয়ে যান, তার অধিকাংশ অনুচর নিহত হন। তার পরিবার বন্দী হয়। সুজাও পরে ধৃত হয়ে নিহত হন। সুজার দুই মেয়ে আত্মহত্যা করে। এক মেয়ে রাজপরী হওয়ার পর রাজার প্রাণনাশের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে প্রাণ হারান। সুজার তিন পুত্র বন্দী থাকে। বাংলার মুঘল সুবাদার মীর জুমলা সুজার পুত্রদের প্রত্যর্পণের দাবীতে এক ওলন্দাজ বণিককে রোসাঙ্গে দূত পাঠান। সুধর্মা সে দাবী প্রত্যাখ্যান করেন এবং মীর জুমলার হুমকিতে বিরক্ত হয়ে সুজার পুত্রদের হত্যা করেন (১৬৬৩)। সুজার পুত্রের প্রতি সহানুভূতিশীল বহু বাঙালি মুসলমানকেও রুষ্ট রাজা নির্বিচারে হত্যা করান। সুজা ও সুজা-কন্যার করুণ পরিণতির কাহিনী নিয়ে রচিত গাথা পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সংকলিত রয়েছে।