গ. হোসেন শাহর সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে জয়ী হয়েই ধন্যমাণিক্য পুনরায় নারায়ণ, রায় কছম ও রায় কচাগের ( রায় চাগ) নেতৃত্বে চট্টগ্রামে এক বিপুল বাহিনী প্রেরণ করেন-চৌদ্দশ ছত্রিশ শকে চাটিগ্রাম গেল ১৫১৪-১৫ খ্রী.) এবার গৌড়-সুলতানের উত্তর চট্টগ্রাম এবং আরাকানরাজের দক্ষিণ চট্টগ্রাম অধিকার করে ত্রিপুরা সৈন্যেরা আরাকানেও হানা দেয়। নারায়ণ এই কৃতিত্বের জন্যে রোসাঙ্গ-মর্দন উপাধি লাভ করেন। কিন্তু হোসেন শাহর পুত্র নুসরৎ খান অচিরে শঙ্খনদ অবধি পুনরুদ্ধার করেছিলেন (১৫১৭ সনের গোড়ার দিকে)। দ্য সিলবেরিয়া তাই ১৫১৭ সনে চট্টগ্রামকে গৌড়-সুলতানের অধিকারে এবং আরাকানরাজকে তার সামন্ত বলে জেনেছিলেন।
ঘ, শ্রীকর নন্দীর উক্তিতে প্রকাশ–ছুটি খান ত্রিপুরাগড় অবধি জয় করে সেখানে সন্নিধান করেছিলেন :
তান এক সেনাপতি লস্কর ছুটিখান
ত্রিপুর নৃপতি যার ডরে এড়ে দেশ।
পর্বত গহ্বরে গিয়া করিল প্রবেশ। (ছুটিখানী মহাভারত)।
তাহলে আরো একবার ত্রিপুরা বিজিত হয়। আরাকানরাজ মঙরাজা বিপুল বাহিনী পাঠিয়ে সম্ভবত ১৫১৮ খ্রীস্টাব্দে উত্তর চট্টগ্রাম নুসরৎ খানের হাত থেকে কেড়ে নেন। এবং সন্দ্বীপ, হাতিয়া, যুগদিয়া, লক্ষ্মীপুর ও ঢাকা জয় করেন। এদিকে দেবমাণিক্য ১৫২২ সনে চট্টগ্রাম দখল করেন। কিন্তু রাখতে পারেন নি। সম্ভবত ১৫২৫ সনের দিকে নুসরৎ শাহ আরাকানের ঘরোয়া বিবাদ ও শাসকগণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম পুনর্দখল করেন। এবং খুদাবখশ খানকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সামন্ত শাসক নিযুক্ত করেন, চকরিয়া ছিল তার শাসনকেন্দ্র। এরপর তা গিয়াসুদ্দীন মুহম্মদ শাহর রাজত্বকাল অবধি (১৫৩৮ খ্র.) স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু রামু প্রভৃতি দক্ষিণ চট্টগ্রামের অবশিষ্টাংশ তখনো আরাকান অধিকারে যে ছিল তার প্রমাণ রয়েছে চান্দিলা রাজার মন্দিরলিপিতে (১৫৪২ খ্রী.)
ঙ. গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহর আমলের চট্টগ্রামস্থ শাসক খুদাবখশ খান ও হামজা খানের ( আমীরজা খান) বিবাদের সুযোগ নিয়ে শেরশাহর পক্ষে নোগাজিল চট্টগ্রাম দখল করে নেন। কাজেই ১৫৩৮-এর পরে চট্টগ্রাম ১৫৫৩ খ্রীস্টাব্দ অবধি শেরশাহ বংশীয়দের হাতে ছিল। তাই দ্য বারোজ চট্টগ্রামকে বাঙলা রাজ্যের ঋদ্ধ বন্দররূপে দেখেছিলেন। ১৫৫৩ সনে মঙ বেঙ সাময়িকভাবে চট্টগ্রাম দখল করে চট্টগ্রাম থেকে মুদ্রা বের করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই বিজয়মাণিক্য মঙবেঙ থেকে উত্তর চট্টগ্রাম ছিনিয়ে নেন। পর বৎসর ১৫৫৪ সনে গৌড়-সুলতান মুহম্মদ খান সুর ওরফে শামসুদ্দীন মুহম্মদ শাহ গাজী বিজয়মাণিক্য থেকে উত্তর চট্টগ্রামের অধিকার কেড়ে নিলেন এবং আরাকান অবরোধ কিংবা অধিকার করে সেখান থেকে মুদ্রা বের করেন (১৫৫৪ খ্রী.) রাজমালার সাক্ষেও প্রমাণ বিজয়মাণিক্য থেকেই পাঠানেরা চট্টগ্রাম ছিনিয়ে নিয়েছিল।
চ. কিন্তু বিজয়মাণিক্যও দাবী ছাড়েননি। ১৫৫৪-৫৫ সনে কালানাজিরের নেতৃত্বে বিপুল বাহিনী চট্টগ্রামে প্রেরিত হয়, আট মাসেও জয়-পরাজয় নির্ধারিত হল না। অবশেষে গোপনে সুড়ঙ্গ খনন করে সেই সুড়ঙ্গপথে ত্রিপুরার সৈন্যরা চট্টগ্রামের পাঠান দুর্গে প্রবিষ্ট হয়ে পাঠান-সৈন্যদের অতর্কিতে পর্যুদস্ত করে এবং মুবারককে বন্দী করে নিয়ে চন্তাইয়ের পরামর্শে চতুর্দশ দেবতার কাছে বলি দেয়। ত্রিপুরার এ বিজয় সম্ভবত ১৫৫৬ সনে ঘটেছিল। তখন থেকে ১৫৭৩ সন অবধি চট্টগ্রাম ত্রিপুরার দখলে ছিল। চট্টগ্রাম জয় করে বিজয়মাণিক্য লক্ষ্যা নদী অবধি পূর্ববঙ্গও জয় করেন। (মুদ্রা : ১৪৮১ শক, ১৫৫৯ খ্র.)। শ্রী শ্রী লক্ষ্যায়ী বিজয়মাণিক্য দেব: চাটিগ্রাম জয়ী। বিজয় মাণিক্যের এই সুযোগ জুটেছিল মুহম্মদ শাহ গাজী ও তাঁর পুত্র গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর (খিজির খান) মুহম্মদ শাহ আদিল ও তাঁর সুবাদার শাহবাজ খানের সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিলেন বলেই (১৫৫৫-৫৭)।
ছ, ১৫৭০ খ্রীস্টাব্দে বিজয়মাণিক্যের মৃত্যুর পর অনন্ত মাণিক্য সম্ভবত দেড় বছর রাজত্ব করেন (১৫৭১-৭২)। তাকে নিহত করে সেনাপতি উদয় মাণিক্য সিংহাসনে বসেন (১৫৭২)। চৌদ্দশ চুরানব্বই শকে উদয় রাজন। (রাজমালা ২য় খণ্ড পৃ. ৬৯)। এ সময় সোলেমান কররানীরও মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র বায়াজিদ কয়েক মাস মাত্র রাজত্ব করেন। কাজেই দাউদ খান কররানীই (১৫৭৩ ৭৬) ত্রিপুরারাজ থেকে চট্টগ্রাম কেড়ে নেন (১৫৭৩)। দাউদের সৈন্যেরা বাধা পেল ত্রিপুরার কাছাকাছি খণ্ডলে। কিন্তু ত্রিপুরা বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে চলল পাঠান বাহিনী। এর পরে ফিরোজ আন্নী আর জামাল খান পন্নীর নেতৃত্বে দাউদ আরো একদল সৈন্য পাঠালেন চট্টগ্রামে। এই দল মেহেরকুলে ত্রিপুরা বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হল। সম্ভবত পাঁচ মাস ধরে এই যুদ্ধ চলে; পঞ্চ বৎসর যুদ্ধ ছিল জামাল পন্নীর সনে। ১৫৭৬ সনে গৌড়ে মুঘল বিজয় ঘটে। কাজেই পাঁচ বৎসর যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব। পাঁচ মাস হওয়াই সম্ভব। এবারেও দাউদ খাঁর জয় হয়।
আইন-ই আকবরীতে চট্টগ্রামের শেখপুর মহলের অপর নাম সোলায়মানপুর বলে উল্লেখ আছে। আইন-ই-আকবরীতে বর্ণিত সাতটি মহলের কোনোটিই শঙ্খনদের দক্ষিণ তীরে ছিল না; এতে বোঝা যায় দাউদ কররানীও শঙ্খনদ অবধি উত্তর চট্টগ্রামই দখল করেছিলেন। গৌড়ে মুঘল বিজয়ের সুযোগেই সম্ভবত আরাকানরাজ ও মঙ ফালঙ (১৫৭১-৯৩) উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করেন। চট্টগ্রাম মুঘল অধিকারভুক্ত হওয়ার আগেই কররানীর রেকর্ড থেকেই চট্টগ্রামের মহলগুলো তোডড়মল মুঘল তৌজিভুক্ত করেন। শিহাবুদ্দীন তালিস তা স্পষ্টভাবেই বলেছেন :