হোসেন শাহ কিংবা নুসরৎ শাহ নাকি বিজিত চট্টগ্রামের নাম ফতেয়াবাদ রেখে ছিলেন। কিন্তু ফতেয়াবাদ নামের কোনো উল্লেখ কবীন্দ্র পরমেশ্বর বা শ্রীকর নন্দীর মহাভারতে নেই। তবে ষোলোশতকে চট্টগ্রাম শহর তথা রাজধানী যে ফতেয়াবাদ নামে পরিচিত ছিল, তা দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু কাব্যে পষ্ট উল্লেখ আছে এবং রাজধানীর নামানুসারে পুরো অঞ্চলটিও ফতেয়াবাদ রূপে পরিচিত ছিল হয়তো। এখনকার চট্টগ্রাম শহরের সাত মাইল দূরে ফতেয়াবাদ গ্রাম আছে। এখানে পুরোনো রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ আজো বিদ্যমান।
ষোলোশতকের মাঝামাঝি কোনো এক নিযাম উত্তর- চট্টগ্রামে জাফরাবাদ গাঁয়ে প্রতাপশালী জমিদার বা আরাকানরাজের সামন্ত ছিলেন। তার প্রমাণ মেলে দৌলত উজিরের উক্তি থেকে :
নগর ফতেয়াবাদ দেখিয়া পূর এ সাধ
চাটিগ্রাম সুনাম প্রকাশ।
চাটিগ্রাম অধিপতি হইলেন্ত মহামতি
নৃপতি নিযাম শাহা শূর
একশত ছত্রধারী সভানের অধিকারী
ধবল অরুণ গজেশ্বর।
ধবল অরুণ গজেশ্বর আরাকানরাজ চট্টগ্রামের সার্বভৌম রাজা, এবং তার অধীনে নিযাম শাহ প্রশাসক–এই অর্থই সঙ্গত। কেননা নৃপতি, শাহ ধবল অরুণ গজেশ্বর প্রভৃতি স্তোক-জ্ঞাপক শব্দের আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করা অনুচিত। ফাজিল নাসির, কবি চুহর, এতিম কাসেম, তমিজী, লোকমান প্রভৃতি কবি উচ্চবিত্তের সাধারণ লোককেও তোয়াজের ভাষায় নৃপতি, সুলতান, অধিপতি বলে অভিহিত করেছেন। কবি মুহম্মদ খানও তার পূর্বপুরুষগণকে স্বাধীন নৃপতিরূপেই বর্ণনা করেছেন। নিামের নামের পরগনা নিযামপুর এখনো বর্তমান। বাহারিস্তান গায়েবীতেও নিযামপুর পরগনার জমিদারের উল্লেখ আছে।
এদিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামে আরাকানরাজ মঙ বেঙের ( যৌবক শাহ ১৫৩১-৫৩) আমলে ত্রিপুরার সৈন্যেরা পার্বত্য পথে আরাকানের চট্টগ্রামস্থ অধিকারে ঘন ঘন হানা দিয়ে লুটপাট করত। ১৫৫৩ সনে কয়েক মাসের জন্যে উত্তর চট্টগ্রামও মঙ বেঙের দখলে ছিল, তা চট্টগ্রামে তৈরি তাঁর নামাঙ্কিত প্রাপ্ত মুদ্রা থেকে প্রমাণিত। আবার গৌড়ের সুর-বংশীয় সুলতান শামসুদ্দিন মুহম্মদ শাহ গাজীরও উক্ত সনে চট্টগ্রামে তৈরি মুদ্রা মিলেছে। অতএব ১৫৫৩-৫৪ সনে চট্টগ্রামে কিছুকাল আরাকানী আর কিছুকাল গৌড় শাসন ছিল।
গৌড় ও পর্তুগীজ সূত্রে জানা যায়, ১৫৩৯-৪০ সনে গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহর চট্টগ্রামস্থ প্রতিনিধি খুদাবখশ খান ও হামজা খানের (আমীরজা খান) বিবাদের সুযোগে নোগাজিল (নওয়াজিস, নিযাম, খিজির?) শেরশাহর হয়ে চট্টগ্রাম দখল করেন। অতএব ১৫৫৩ সনে মঙ বেঙই সম্ভবত উত্তর চট্টগ্রামে হানা দিয়ে তা কিছুকাল দখলে রাখেন।
আরাকান রাজ মঙ বেঙের সময়েই দক্ষিণ চট্টগ্রামে মঘী কানি ও দ্রোনে জমির পরিমাপ পদ্ধতি এবং মঘী সন চালু হয়। মঘী সন বাঙলা সন থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরে কম।
মুহম্মদ খানসুর ওর্ষে শামসুদ্দীন মুহম্মদ খান গাজী চট্টগ্রাম পুনর্দখল করে আরাকান আক্রমণ করেন। কিন্তু সম্ভবত আরাকান বেশিদিন তার দখলে থাকেনি। যদিও আরাকানে তৈরি তাঁর মুদ্রা (৯৬২ হিজরি ১৫৫৩-৪ খ্রী.) মিলেছে। ১৫৫৬ সনে ত্রিপুরারাজ বিজয় মাণিক্য (১৫২৮ ২৯-১৫৭০ খ্রী.) চট্টগ্রাম অবরোধ করেন:
আট মাস যুদ্ধ করে পাঠানের সনে
লইতে না পারে গড় চাটিগ্রাম স্থানে। (রাজমালা)
এই সময় বিজয় মাণিক্যের পাঠান সৈন্যেরা বিদ্রোহ করলে, তাদের হত্যা করা হয়। গৌড়ের পাঠান সুলতান এতে ক্রুদ্ধ হয়ে তার শ্যালক মুবারকের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে এক বাহিনী প্রেরণ করেন :
এই সব বৃত্তান্ত তাতে পাঠান শুনিল।
ক্রোধে গৌড়েশ্বর বহু সৈন্য দিল রণে
মমারক খাঁ সৈন্য সমে চাটিগ্রামে গেল।
ভঙ্গ দিল ত্রিপুর সৈন্য মগলে জিনিল। (রাজমালা)
কিন্তু সম্ভবত পুনরাক্রমণে মুবারক পরাজিত ও ধৃত হয়ে কালী কিংবা চতুর্দশ দেবতার বেদীমূলে বলিরূপে প্রাণ হারান। বিজয়মাণিক্য ব্রহ্মপুত্র নদ অবধি জয় করে তথায় স্নান করেন। এই ঘটনার স্মারক-মুদ্রা মিলেছে : শ্রী শ্রী লক্ষ্যায়ী বিজয় মাণিক্য দেব] (১৪৮১ শক ১৫৫৯ খ্রী.) মুবারক সম্ভবত মুহম্মদ শাহ গাজীরই শ্যালক। মনে হয়, ১৫৭০ সন অবধি চট্টগ্রাম বিজয়মাণিক্যের শাসনে ছিল। উক্ত সনে সম্ভবত সোলমান কররানী চট্টগ্রাম জয় করেন।
অতএব উপরের আলোচনা থেকে আমরা কয়েকটি তথ্য পাচ্ছি :
ক. শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ ১৪৭৬৮২ বা জালালুদ্দীন ফতেহ শাহর ( হোসাইনী) আমলে কিংবা তাদের পরের কার গৌড়-সুলতান খোঁজা সেরা, সইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ অথবা শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহ–এ কয়জনের যে-কোনো কারো সময়ে চট্টগ্রাম আরাকান-শাসনভুক্ত হয়। শাহ বারিদ খানের পদবন্ধ ও দ্বিজ বা পণ্ডিত ভবানীনাথের লক্ষ্মণ দিগ্বিজয় এ ধারণার পরিপূরক।
খ. হোসেন শাহ ১৫১২ সনে উত্তর চট্টগ্রাম দখল করেন। ধন্যমাণিক্য ১৫১৩ সনের গোড়ার দিকে চট্টগ্রাম ছিনিয়ে নেন:
চৌদ্দশ পাঁচতিস শকে নিজ বাহুবলে
চাটি গ্রাম বিজই বলি মোহর মারিল (রাজমালা, সাহিত্য পরিষৎ পুথি)
এই বিজয়ের স্মারক চট্টগ্রামজয়ী স্বর্ণমুদ্রা মিলেছে। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই ধন্যমাণিক্য সে অধিকার হারান। ১৫১৩ সনের শেষের দিকে হোসেন শাহর সৈন্য চট্টগ্রাম দখল করে। এতে হোসেন শাহর সঙ্গে ধন্যমাণিক্যের বিবাদ বাধে। গৌরমল্লিক, হৈতন খান ও হোসেন শাহর নেতৃত্বে তিনবার যুদ্ধ হয়। প্রথম দুই যুদ্ধে হোসেন শাহর পরাজয় ঘটে। তৃতীয় যুদ্ধে হোসেন শাহ ত্রিপুরার রাজধানী রাঙ্গামাটি অবধি হানা দিলেন এবং মেহেরকুল অবধি অঞ্চল মোয়াজ্জমাবাদ পরগনাভুক্ত করে খাওয়াজ খানকে প্রশাসক নিযুক্ত করেন।