দ্বিজ ভবানী নাথের রামাভিষেক বা লক্ষ্মণ দিগ্বিজয় কাব্য ষোলা শতকের প্রথম দশকে জয়ছন্দ বা জয়চান্দ রাজার আগ্রহে রচিত। দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে জয় ছন্দ ১৪৮২-১৫২৩ অবধি কর্ণফুলী ও শঙ্খনদ মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাজা ছিলেন এবং তিনি ছিলেন আরাকান সামন্ত।৮৮ এ তথ্য নির্ভুল হলে বুঝতে হবে শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহর (১৪৭৬-৮২) সময়ে বা তার পরে চট্টগ্রাম গৌড়-সুলতানের হস্তচ্যুত হয়।
অতএব শামসুদ্দীন ইউসুফ কিংবা জালালউদ্দীন ফতেহ শাহর আমলে চট্টগ্রামে আরাকান অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় এবং ১৫১২ খ্রীস্টাব্দ অবধি চট্টগ্রাম আরাকান শাসনে থাকে। মনসামঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্তের উক্তিতে যদি কিছু সত্য থাকে, তাহলে বলতে হবে চট্টগ্রাম ফতেহ শাহর শাসনাধীনে ছিল না। বিজয় গুপ্ত প্রস্তাবনায় বলেছেন–মুলুক ফতেয়াবাদ বাঙ্গরোড়া তক্ সীম। পশ্চিমে ঘাঘর নদী পূর্বে ঘণ্টেশ্বর। মধ্যে ফুল্লশী গ্রাম পণ্ডিত নগর। ফতেহ শাহ হোসাইনীর আমলে ১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন। সুলতান শাহজাদা ওর্ফে খোঁজা সেরা, সইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ কিংবা শামসুদ্দীন মুজফফর শাহর রাজত্বকালে চট্টগ্রাম আরাকানরাজার শাসনে ছিল। তারপর ১৫১২ সনে ত্রিপুরারাজ ধন্যমাণিক্য আরাকানীদের হাত থেকে চট্টগ্রামের উত্তরাংশ কর্ণফুলী নদী অবধি ছিনিয়ে নেন। এই সময় গৌড়-সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ আলফা হোসাইনী বা আলফা খান নামের এক বণিকের সহায়তায় চট্টগ্রাম দখল করলেন। এরূপে ধন্য মাণিক্যের সঙ্গে হোসেন শাহর বিবাদ উপস্থিত হল। বন্যমাণিক্য আবার সৈন্য পাঠিয়ে ১৫১৩ সনে হোসেন শাহর বাহিনীকে পরাজিত করে চট্টগ্রামে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুদ্রা তৈর করান :
তারপরে শ্রীধন্য মাণিক্য নৃপবর :
চাটিগ্রাম জিনিলেক করিয়া সমর।
চৌদ্দশ পাঁচত্রিশ শাকে সমর জিনিল
চাটিগ্রাম জয় করি মোহর মারিল।
গৌড়ের যতেক সৈন্য চট্টলেতে ছিল
শ্রীধন্য মাণিক্য তাকে দূর করি দিল।
অথবাঃ চাটিগ্রাম হতে ভঙ্গ দিল গৌড় সেনা। মারণে কাটনে ভঙ্গ দিন গৌড় সেনা।
হোসেন শাহ প্রতিশোধ নেবার জন্যে ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করলেন তাঁর সেনাপতি হৈতন খান (হায়াতুন্নবী) ও গৌড়মল্লিক (গৌর মল্লিক) ধন্যমাণিক্যের হাতে পরাজিত হন বটে, কিন্তু তার আগেই তিনি মেহেরকুলাদি অঞ্চল দখল করে মোয়াজ্জমাবাদ শিকভুক্ত করেন। ইতিমধ্যে এ বিবাদের সুযোগে আরাকানরাজ চট্টগ্রাম পুনর্দখল করেছিলেন। গৌড় মল্লিককে পরাজিত করে ধন্যমাণিক্যের সাহস বেড়ে গিয়েছিল, তিনি নারায়ণ ও চয়াগের নেতৃত্বে বিপুল বাহিনী নিযুক্ত করলেন। ধন্যমাণিক্য নিজেও এদের সহগামী ছিলেন। (শ্রীধন্যমাণিক্য চলে চাটিগ্রাম লৈতে– রাজমালা)। নারায়ণ রামু অবধি জয় করে রোসাঙ্গ-মর্দন খেতাব লাভ করেন। কিন্তু সম্ভবত কয়েক মাসের মধ্যেই আরাকানরাজ চট্টগ্রাম পুরাধিকার করেছিলেন। আরাকানীদের হাত থেকেই নুসরৎ খান পরাগল খানাদির সহায়তায় উত্তর চট্টগ্রাম জয় করেন। আরাকানরাজ কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদের মধ্যবর্তী চক্রশালায় ঘাঁটি করে গৌড়- সুলতানের বাহিনীর সঙ্গে সম্ভবত ১৫২৫ সন অবধি দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন। এ ব্যাপারের আভাস আছে কবি শাহ বারিদ খানের একটি পদবন্ধে।৯২ নুসরৎ খান পরবর্তী কোনো অভিযানে শঙ্খনদ অবধি দক্ষিণ চট্টগ্রামও দখল করেন। দ্য বারোজের বর্ণনায় প্রকাশ Joao de Silviera ১৫১৭ সনে চট্টগ্রাম বন্দরকে গৌড়-সুলতানের দখলে এবং আরাকানরাজকে গৌড়-সুলতানের সামন্ত বলে জেনেছিলেন। আরাকানরাজ মঙইয়াজা বা মঙ রাজা (১৫০১-২৩) এ বিপর্যয়েও আশা ছাড়লেন না। তিনি সেনাপতি ছেদুইজা, মন্ত্রী ছাঙ্গেগ্রী ও রাজকুমার ইরে মঙের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম পুনরাধিকারের জন্যে ১৫১৭ সনে এক বিপুল বাহিনী প্রেরণ করেন। পরাজিত হয়ে চক্রশালার মুসলিম সেনানীশাসক মুরাসিন বা মীর ইয়াসীন ভয়ে পালিয়ে গিয়ে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে (সম্ভবত চাঁদপুর হয়ে সোনারগাঁয়ে) আশ্রয় নেন। (রাজোয়াং-রাজবংশ ৯৪)। এরূপে চক্রশালা আরাকান অধিকারে চলে গেল। আরাকানরাজের এই দিগ্বিজয়ী বাহিনী চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, লক্ষ্মীপুর ও ঢাকা জয় করে লক্ষ্মীপুরে শাসনকেন্দ্র স্থাপন করে এবং ১৫১৪-১৮ সনে আরাকানরাজ ঢাকা ভ্রমণ করেন। কিন্তু আরাকানের এই দিগ্বিজয় স্থায়ী হয়নি। উত্তর চট্টগ্রামেও আরাকান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল না এ যুদ্ধে। তবু কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীর অবধি গোটা অঞ্চল আরাকান শাসনে রয়ে গেল। ১৫২২ সনে ত্রিপুরারাজ দেবমাণিক্য উত্তর চট্টগ্রাম জয় করেন। এর ফলে উত্তর চট্টগ্রামবাসী মঘেরা আরাকানে পালিয়ে যায় বলেকিংবদন্তি আছে। একে মঘধাওনী বা মঘ পলায়নী বলে। এ অভিযানে ত্রিপুরার সেনাপতি ছিলেন রায় চাগ। সম্ভবত তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামও আক্রমণ করেন (রাজমালা)। দেবমাণিক্যও চট্টগ্রামে অধিকার প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারেন নি। এদিকে আরাকান সিংহাসনের তখন নিরাপত্তা ছিল না। গজপতি (১৫২৩-২৫) মঙ সাউ (১৫২৫), থাতাসা (১৫২৫-৩১) প্রভৃতি জ্ঞাতিরা আট বছরের সময় পরিসরে সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন। এই দুর্বলতার সুযোগে নুসরৎ শাহ ১৫২৫ খ্রীস্টাব্দের দিকে চট্টগ্রামে স্বাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এ সময় থেকে উত্তর চট্টগ্রাম ১৫৫৩ সন অবধি গৌড়–সুলতানের শাসনাধীন ছিল।