সম্ভবত বিহারের পীর বদরউদ্দীন বদরই আলাম (মৃত্যু ১৩৪০ খ্রী. বর্ধমানের কালনায় যার নকল সমাধি রয়েছে) আর চট্টগ্রামের পীর বদর অভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু অন্য অনেকের মতে, ১৪৪০ খ্রীস্টাব্দে বদর আলামের মৃত্যু হয়। ইতিহাস ও মুক্তল হোসেন কাব্য সূত্রে জানা যায় রাস্তি খানের বংশধরগণ ইব্রাহিম ওর্ষে বিরহিম অবধি (ইনিও উজির ছিলেন) গৌড় আরাকান ও ত্রিপুরা রাজার অধীনে (চট্টগ্রাম যখন যে রাজ্যভুক্ত থাকত) চট্টগ্রামের শাসনকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। রাস্তি। খান স্বয়ং রুকনুদ্দীন বারবক শাহর (১৪৫৯-৭৬ খ্রী.) কর্মচারী ছিলেন।
পরাগল খান ও ছুটিখান ছিলেন আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রী.) ও নুসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২ খ্রী.) আমলে ফেনী নদী ও রামগড় মধ্যবর্তী সীমান্ত রক্ষী সেনানী বা লস্কর। হামজা খান, নসরত খান ও জালাল খান গৌড়, ত্রিপুরা ও আরাকান রাজের অধীনে শাসনকার্যে নিযুক্ত ছিলেন।
শিহাবুদ্দীন তালিস ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে চট্টগ্রামে মুঘলবিজয় বর্ণনা প্রসঙ্গে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহর চট্টগ্রাম বিজয় ও চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর অবধি রাস্তা নির্মাণের কথা বলেছেন। তালিস স্বচক্ষে সে রাস্তার ভগ্নাবশেষ দেখেছেন।৭৭ এখনো ফখরুদ্দীনের নামের ফখরুদ্দীনের পথ (ফঅরদ্দীনের অদ) নিশ্চিহ্ন হয়নি। এ রাস্তাও লালমাই অঞ্চল দিয়ে প্রসারিত ছিল।
সেনানী কদর খানের সৈনাপত্যে চট্টগ্রাম বিজয়ও স্বীকার করা চলে।৭৮ (ইনি মালিক পিণ্ডার খান খালজী ওফে কদর খান নন। তিনি নিহত হওয়ার আগে যে কয়মাস সোনারগাঁয়ে ছিলেন, সে সময় বর্ষাকাল ছিল। কাজেই তিনি চট্টগ্রাম জয় করেননি।)
সম্ভবত ১৩৩৮ থেকে ১৪৫৯ খ্রীস্টাব্দ অবধি চট্টগ্রাম গৌড় শাসনে ছিল। পনেরো শতকের গোড়া থেকে ১৪৫৯ খ্রীস্টাব্দ অবধি যে চট্টগ্রাম গৌড়-সুলতানদের অধিকারভুক্ত ছিল তার প্রমাণ বহু :
ক. চীনা দূতের ইতিবৃত্ত ১৪০৯, ১৪১২, ১৪১৫।
খ. আরাকানরাজ নরমিখলের বা মঙ সাউ মঙের গৌড় দরবারে আশ্রয় গ্রহণ (১৪০৪-৩৩ খ্রী.)
গ. চট্টগ্রামে তৈরি দনুজমর্দনদেব গণেশ (১৪১৭), মহেন্দ্র (১৩১৮) ও জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহর (১৪১৫-১৬,১৪১৮-৩১) প্রাপ্ত মুদ্রাই তার সাক্ষ্য। চীনা দূতেরা চট্টগ্রাম হয়েই গৌড়ে গিয়েছিলেন।
আবার চৌদ্দ শতকের রাজনৈতিক খবরও একেবারে বিরল নয়। ১৩৫২ খ্রীস্টাব্দের দিকে ফখরুদ্দীনের পুত্র ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহ থেকে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ চট্টগ্রাম সমেত পূর্ববাঙলার অধিকার লাভ করেন। এর পরে সিকান্দর শাহ (১৩৫৯-৮৯খ্রী.) ও তাঁর পুত্র গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ (১৩৮৯-১৪১০ খ্র.) পনেরো শতকের প্রথম দশক অবধি রাজত্ব করেন। আযম শাহর আমলেই আরাকানরাজ নরমিখলে বা মঙ সাউ মঙ গৌড়ে আশ্রিত হন (১৪০৪ খ্রী.) এবং জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৫-১৬, ১৪১৮-৩১ খ্রী.) ১৪৩০ খ্রীস্টাব্দে তাকে আরাকান সিংহাসনে পুন:প্রতিষ্ঠিত করেন। অবশ্য আরাকানী বিদ্বানদের মতে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহই (১৪৩৩-৫৯) মঙ সাউ মঙকে সিংহাসন পাইয়ে দিয়েছিলেন (বর্মা রিচার্স সোসাইটিস এ্যানিবারর্সারি ভলিউম ১৯৬০)। গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ (১৩৮৯-১৪১০) যে চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন তা কেবল মঙ সাউ মঙের আশ্রয় গ্রহণ থেকেই নয়, বিহারের দরবেশ মুজাফফর শামস বলখী হজ যাত্রার সময় চট্টগ্রাম থেকে তার কাছে যে-সব চিঠি লিখেছিলেন তা হতেও জানা যায়। গিয়াসুদ্দিন চীনদেশে দূত পাঠিয়েছিলেন। চীনা সূত্রেও ধারণা হয় যে চট্টগ্রাম আযম শাহর অধীনে ছিল। তার পর সইফুদ্দীন হামজা শাহ, শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ, আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ, গণেশ, মহেন্দ্র, জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ, শামসুদ্দীন আহমদ শাহ এবং নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৩-৫৯) প্রভৃতি সুলতানের আমলেও চট্টগাম গৌড়রাজ্যভুক্ত ছিল। মঙ সাউ মঙের সিংহাসনে আরোহণ (১৪৩০) থেকে আরাকানে মুসলমানদের প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রবল হয়। রাজার মুসলিম নাম, মুদ্রায় কলেমা ও আরবি হরফ তার প্রমাণ। ইলিয়াস শাহ বংশীয় সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহর রাজত্বকালে মঙ সাউ মঙের ভাই মঙ খ্রী ওফে আলি খান (১৪৩৪-৫৯) রামুর কিছু অংশ অধিকার করেন। এবং সে সূত্রে আরাকানরাজ গৌড়সুলতানের প্রভাবমুক্ত হন। রামুর যে-অংশ আরাকানরাজের অধীনে গেল সে-অংশ রাজারকুল আর যে-অংশ চাকমা সামন্তের(?) অধিকারে রইল তা চাকমারকুল নামে আজো পরিচিত। মাহমুদ শাহর রাজত্বের শেষ বছরেই (১৪৫৯ খ্র.) চট্টগ্রাম গৌড় সুলতানের হস্তচ্যুত হয়। মঙ খ্রী-পুত্র বসউ পিউ কলিমা শাহ (১৪৫৯-৮২) ১৪৫৯ সনে উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করেন। কিন্তু তার অধিকার দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি। তাই রাস্তিখানের উৎকীর্ণ মসজিদ লিপিতে (১৪৭৩-৭৪ খ্রী.) মাহমুদ শাহর পুত্র রুকনুদ্দীন বারবক শাহকে চট্টগ্রামের অধিপতি দেখি।৮৫ এর পরে এক সময় চট্টগ্রাম আরাকান অধিকারভুক্ত হয়।
চট্টগ্রামের নিযামপুর ও ফেনী অঞ্চলে শাহজাদা খান্দানী সংক্ষেপে শাহজাদখানী বলে এক সম্ভ্রান্ত বংশের ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত শ্রুতি-স্মৃতি থেকে জানা যায়, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহর আমলে মাতুল কিংবা পিতৃব্য কর্তৃক সিংহাসনে বঞ্চিত হয়ে এক শাহজাদা গৌড়ে এসে মাহমুদ শাহর কন্যা বিয়ে করে চট্টগ্রামের আধুনিক নিযামপুর অঞ্চলে বসতি নির্মাণ করেন। এক দরবেশ তাকে বলেছিলেন তার হাতী যেখানে লুটিয়ে পড়বে সেখানেই যেন তিনি বসতি করেন। এখানেই হাতী লুটে পড়েছিল বলে স্থানটির নাম হাতী লুটাগাঁ এবং শাহজাদার নাম মাহমুদ ছিল বলে অঞ্চলটি মাহমুদাবাদ নামে অভিহিত হয়। এটিই কি মাহমুদ শাহ কিংবা রুকনউদ্দীন বারবকের টাকাশাল অঞ্চল মাহমুদাবাদ! অবশ্য যশোর-ফরিদপুর অঞ্চলও মাহমুদাবাদ্য নামে পরিচিত ছিল (হিসটরী অব বেঙ্গল ঢাকা ইউনিভারসিটি ভলিয়ম ২য় পৃ: ১৮৯)। এই শাহজাদার সঙ্গে সাতটি খান্দানী পরিবার আর এদেরই কারো জামাতারূপে বিবাহ-সূত্রে একটি অর্ধ অভিজাত পরিবার এই সাড়ে সাত ঘর আলোচ্য অঞ্চলে বসতি নির্মাণ করে বলেও লোকশ্রুতি আছে। এদের একজন উসমান কাজি। এদের বংশধরগণ নিযামপুর ও ফেনীর আমিরাবাদ পরগনার বিভিন্ন গায়ে ছড়িয়ে আজো বাস করে। এই শাহজাদা বংশীয় শেখ মুহম্মদ ভূঁইয়া শমসের গাজীর মিত্র ছিলেন। তার কথা শেখ মনোহরের শমসের গাজীনামায় বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এইকিংবদন্তি সম্ভবত গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহর জামাতা খিজির খান–তুর্কী সংপৃক্ত অথবা শের শাহর ভাগিনেয় মুরারিজ খান ওর্কে সুলতান মুহম্মদ শাহ আদিল কর্তৃক ইসলাম শাহ সুরের পুত্র ফিরোজপুরের হত্যাকাহিনীর সঙ্গে জড়িত।৮৭ এই ফিরোজ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহর পুত্রও হতে পারেন। এ সূত্রে উল্লেখ্য যে পরাগল খান-বংশীয়রাও উক্ত সাড়ে সাত ঘরের একঘর এবং তাঁরা নিজেদের এক উজির জুজার খানের বংশধর বলে দাবী করেন, যদিও পরাগলী মহাভারত সূত্রে আমরা পরাগল খাকে রুদ্র-বংশীয় তথা স্থানীয় দীক্ষিত মুসলিম বংশজ বলে জানি। অবশ্য কবি-প্রযুক্ত রুদ্র অর্থে যোদ্ধা বা বীর ধরলে রাস্তি খান পরাগল খানকে তুর্কী বা আফগান বংশীয় বলেই মানা যাবে।