চ. বঙ্গীয়সূত্রে জানা যায়, নয়শতকের হরিখেল মণ্ডলের বৌদ্ধ রাজা কান্তিদেব একবার চট্টগ্রামে অধিকার বিস্তার করেন। চট্টগ্রামের এক মন্দিরে তার একটি অসম্পূর্ণ তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। কান্তিদেবের রাজধানী ছিল বর্ধমানপুরা। ফরিদপুর খুলনা প্রভৃতি উপকূলাঞ্চলই সম্ভবত হরিখেল মণ্ডল। এখান থেকেই সমুদ্রপথে হয়তো কান্দিদেব স্বল্পকালের জন্য চট্টগ্রামের অধিকার পান এবং তাম্রপত্র সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বিতাড়িত হন।
ছ. চন্দ্ররাজ শ্রীচন্দ্রের আমলে বৈশালীরাজ চূড়চন্দ্ৰসিংহ (৯৫১-৫৭) চট্টগ্রাম জয় করতে এসে চিৎ-তৎ-গঙ (যুদ্ধ করা অন্যায়) –এই আপ্তবাণী স্তম্ভে উত্তীর্ণ করে ফিরে যান। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা থুরতন < সুরচন্দ্র (?) তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। এমনও হতে পারে যে আনন্দচন্দ্রের পরবর্তী সুরচন্দ্র বাচীর কোনো লোক চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের মতে সুলতান চট্টগ্রামের আরব বণিক শাসক। আবার ত্রিপুরা রাজ্যকেও থুরতন বলা হত।
জ, চূড়চন্দ্র সিংহের চট্টগ্রাম বিজয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সম্ভবত চন্দ্র-সামন্তরাই চট্টগ্রাম শাসন করতে থাকেন এবং জাতবর্মণ আধিপত্য বিস্তার করেন। কেননা, পগারাজ অনোরটা (১০৪৪-৭৭) ১০৫৯ সনে বা তার কিছু পরে উত্তর-আরাকান জয় করেন। অনোরটার রাজ্যের উত্তর পূর্বসীমা ছিল পট্টিকের। পট্টিকের অঞ্চল অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। চট্টগ্রামে অনোরটা নিজেই সম্ভবত এসেছিলেন। (He visited the Indian land of Bengal, perhaps Chittagong and planted magical images of men there) চট্টগ্রাম অনোরটা বংশীয়ের দখলে অনেককাল ছিল। একারণেই সীমান্তের পট্টিকের রাজপরিবারের সঙ্গে পগারাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। পট্টিকের-র এক রাজকুমার পগারাজ Kyanzittha–র (১০৮৪-১১১২) কন্যা Sherpe einthi প্রেমে পড়েছিল। প্রতিবেশী রাজ্যের কুমারের সঙ্গে একমাত্র সন্তান Shewe-র বিয়ে হলে রাজ্যের অধিকার ভিনদেশী জামাতার হাতে চলে যাবে–এ বিবেচনায় তাকে বিমুখ করা হলে রাজপুত্র আত্মহত্যা করে। আর এই রাজকন্যারই সন্তান রাজা Alaungsithu (১১১২–৬৭) পট্টিকের রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। সে কন্যার সৎপুত্র নরথু কর্তৃক হত্যাকাহিনী বর্মা ও আরাকানে ভিন্নভাবে চালু আছে বর্মারাজ ইতিবৃত্তে ও সাহিত্যে এ কাহিনী বিবৃত রয়েছে। Alaungsithu–র বংশধর নরসিংহপতি (১২৫৪–৮৭) ১২৭৭ সনে কুবলাই খানের বাহিনীর সঙ্গে Ngasaunggyan–এ যুদ্ধ করেন। মার্কোপলো বলেছেন Mien–এর রাজার সঙ্গে বাঙলার রাজাও যোগ দিয়েছিলেন এই যুদ্ধে। Hall প্রভৃতি সবাই Marco Polo–র এ স্থলে বাঙলার উল্লেখ করা ভুল হয়েছে বলে মনে করেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় Marco Polo স্বয়ং কুবলাই খাঁর দরবারে উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন এবং তিনি বাঙলার যে-পরিচয় দিয়েছেন তাতে অজ্ঞতার ছাপ নেই। কাজেই এ যুদ্ধের প্রতিপক্ষ নির্দেশে তার ভুল হওয়ার কথা নয়। সম্ভবত চট্টগ্রামের সামন্তশাসক তখনো পগারাজের অনুগত এবং এ যুদ্ধে সহায়তা করতে বাধ্য ছিলেন। ১২৮৩ সনে দ্বিতীয় মোঙ্গল আক্রমণের ফলে কেন্দ্রীয় শাসন শিথিল হয়ে পড়ে, তার ফলে উত্তর আরাকান (এবং এ সঙ্গে চট্টগ্রামও) স্বাধীন হয়ে যায়। এ সময় পর্গরাজ্যে মুসলিম প্রভাবও লক্ষণীয়। ঝড়ে বাণিজ্যতরী ভঙ্গ হলে Butta নামে এক আরব বণিক বা নাবিকও এ সময় পগাঁয় বাস করতে থাকেন। এর এবং Raman kan (Rahman Khan) এর দরবারে প্রতিপত্তি ছিল, এ ছাড়া সৈন্যদলে অনেক মুসলিম ও ভারতীয় থাকতো
ঝ. এগারো-বারো শতকে চট্টগ্রাম সম্ভবত পগাসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তেরোশতকের প্রথমার্ধে মধুসূদনদেব, বিশেষ করে দামোদরদেবের (১২৪৩) শাসনে ছিল–দামোদরদেবের তাম্রশাসনই তার প্রমাণ। এর পরেও হয়তো পগারাজ চট্টগ্রাম শাসকের আনুগত্য পেতেন, নইলে ১২৭৭ সনে তাকে কুবলাই খানের সঙ্গে যুদ্ধে পগারাজের সহায়করূপে পেতাম না।
ঞ. রাজমালা সূত্রে জানা যায়, ত্রিপুরারাজ ছেঙথুমফা-ই প্রথম চট্টগ্রাম জয় করেন। এ দশশতকের কথা, কিন্তু তার অধিকার স্থায়ী হয়েছিল বলে মনে হয় না। অবশ্য রহফা ও তাঁর পিতা বা ভাতার আমলে চট্টগ্রাম ত্রিপুরা শাসনে ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। পর্গার বিপর্যয়ের সুযোগে আরাকান রাজ Mihnti প্রবল হয়ে ওঠেন। তিনি চট্টগ্রাম জয় করেন এবং সোনার গাঁয়ের সেন রাজা তার বশ্যতা স্বীকার করে করদান করতেন। মার্কোপলো এবং ১৩১৩ সনে স্যার জন হার্বাট চট্টগ্রাম পর্যটন করেন। হার্বাট চট্টগ্রামকে সমৃদ্ধ ও জনবহুল নগরীরূপে দেখেছেন। Mihnti বা। মেঙদির আমলে উত্তর বঙ্গের চাকমা রাজধানী মাইচাগির (১৩৩৩-৩৪) আরাকান অধিকারে আগে। যুদ্ধে কাঁইচার ত্রিশ হাজার বাঙালি মজুর হিসেবে যোগদান করে।
২. মধ্যযুগ : প্রাক-মুঘল আমল
মধ্যযুগ : প্রাক-মুঘল আমল
(তেরো শতক থেকে ১৬৬৫ খ্রীস্টাব্দ অবধি)
ত্রিপুররাজ ছেঙগুম ফা সম্ভবত ১২৪০-৬০ খ্রীস্টাব্দের দিকে রাজত্ব করতেন। তার আমলেই পার্বত্য ভোটচীনা তিপরা জাতি চট্টগ্রাম জয়৬৮ করে বালঙার রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হয়। সম্ভবত ফখরুদ্দীন মুবারক শাহর চট্টগ্রাম বিজয়ের পূর্বে দামোদর দেব বংশীয়গণ স্বাধীনভাবে কিংবা আরাকান অথবা ত্রিপুরার সামন্ত হিসাবে চট্টগ্রাম শাসন করতেন। মনে হয়, তাদের কারো হাত থেকে সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ চট্টগ্রামের অধিকার ছিনিয়ে নেন (১৩৩৮ ৩৯ খ্রী.) চট্টগ্রামের কিংবদন্তিতে এবং শিহাবুদ্দীন তালিসের বর্ণনায় এর সমর্থন আছে। আমাদের ধারণায় ইবন বতুতাও (১৩৪৬ খ্রী.) সদকাউন (Sadkawan) নামে ফখরুদ্দীনের আমলের এই চট্টগ্রামকেই নির্দেশ করেছেন। কবি মুহম্মদ খানের মঞ্জুল হোসেন-এর ভূমিকা ভাগ থেকে জানা যায় ফখরুদ্দীনের আমলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন কদর বা কদল খান গাজী। তাঁর নামে একটি গ্রাম আজো কদলপুর বলে পরিচিত। এই কদর খানের আমলেই পীর বদরুদ্দীন আলাম ও কবির পূর্বপুরুষ মাহিআসোয়ার আরব বণিক হাজী খলিলের সঙ্গে চট্টগ্রামে উপনীত হন। ফখরুদ্দীন শায়দা নামের এক দরবেশকে চট্টগ্রামের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। এ ভণ্ড সাধু ফখরুদ্দীনের পুত্রকে হত্যা করার অপরাধে নিহত হয়। কবি মুহম্মদ খান গৌড় সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর (১৪৫৯-৭৬ খ্রী.) চট্টগ্রামস্থ কর্মচারী বা প্রতিনিধি রাস্তি খানের বংশধর। তিনি তার পূর্বপুরুষের তালিকা দিয়েছেন :