Belava তাম্রপত্রের আলোকে অনুমান করা সম্ভব যে ললিত চন্দ্রের স্বল্পকাল (?) রাজত্বের পরেই (কলিঙ্গ দেশজ বা পশ্চিমবঙ্গীয় হরি বর্মণের মন্ত্রী ভবদেব ভট্ট রাঢ়ের সিদ্ধিলা গায়ের লোক। তার পিতামহ আদিদেব বঙ্গরাজের মন্ত্রী ছিলেন) উচপদস্থ কর্মচারী বজবৰ্মণ বা তার পুত্র জাতবর্মণ চন্দ্র সিংহাসন দখল করেন। সম্ভবত ১০৭০ খ্রীস্টাব্দের পরেই বর্মণ অভুত্থান ঘটে। জাতবর্মণ দিগ্বিজয়ী ছিলেন। বৈনর পুত্র পৃথুর গৌরব মুছে দিয়ে, কর্ণের মেয়ে বীরশ্রীকে বিয়ে করে, অঙ্গগণের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, কামরূপের গর্ব খর্ব করে, দিব্যের বাহুবলকে লজ্জা দিয়ে গোবর্ধনের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটিয়ে এবং বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদেরকে ধনদান করে তিনি তার সার্বভৌমত্ব বিস্তার করেন।
এই উক্তির মধ্যেকার কালকুচিরাজ কর্ণ ও কৈবর্তদিগের পরিচয় আমরা জানি। এই দিব্য দ্বিতীয় মহীপালের সময়ে (১০৭০-৭৫) বিদ্রোহী হয়ে বরেন্দ্রে স্বাধীনভাবে কিছুকাল রাজত্ব করার সুযোগ পান। জাতবর্মণের পরে তার পুত্র হরিবর্মণ ও সামলবর্মণ রাজত্ব করেন। এদেরও রাজধানী বিক্রমপুরেই ছিল। কিন্তু খুব সম্ভব বর্মণদের আদি নিবাস কলিঙ্গে, যেখান থেকে তারা রাঢ়ের সিংগুর অঞ্চলে বাস করতে থাকেন এবং বজ্রবর্মনের আমলে বিশেষ ক্ষমতাশালী হন। হরিবর্মণের মন্ত্রী ভবদেব ভট্টরাও রাঢ়বাসী এবং বঙ্গরাজ মন্ত্রী। বর্মণরা ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈষ্ণব ছিলেন। সামলবর্মণের পুত্র ভোজবৰ্মণই Belaoa তাম্রশাসনটি তার রাজত্বের পঞ্চম বছরে রাজধানী বিক্রমপুর থেকে প্রদান করেন। তিনি বারোশতকের প্রথমার্ধেই হয়তো রাজত্ব করেন। ভোজবর্মণের পর আমরা পাট্টিকের রাজ্যের তথা সমতট অঞ্চলের বিশেষ কোনো সংবাদ পাইনে। কেবল রণবঙ্কমলু হরিখেল দেবের (১২০৪-২১) তাম্রশাসনই (১২২১ খ্রী.) পাই। এ তাম্রপত্রে রণবঙ্কম পাট্টিকের-র বৌদ্ধবিহারে ভূমিদান করেছেন।
তিনটি তাম্রশাসনের প্রমাণে বঙ্গ-সমতটে এক দেববংশের রাজত্ব স্বীকার করতে হয়। কিন্তু হরিখেলদেবের সঙ্গে এ বংশের সম্পর্ক নির্ণয় করবার মতো তথ্য আজো হাতে আসেনি। পুরুষোত্তমদেব, মধুসূদন (মথন) দেব, বাসুদেব, দামোদরদেব, দশরথদেব-এ পাঁচজনের নাম তাম্রশাসন থেকে পাচ্ছি। সম্ভবত এঁরা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের আমলের পাটিকের সামন্ত কুসুমদেবের বংশধর। এবং লখনৌতিতে মুসলিম অধিকারের সুযোগে সমতট অঞ্চলে বর্মণদের পরে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। হরিখেলদেব সম্ভবত পুরুষোত্তমের ভাই। তার মৃত্যুর পর পুরুষোত্তমের পুত্র মধুসূদনই সিংহাসন লাভ করেন। দামোদরদেবের মেহের তাম্রলিপি তার রাজত্বের চতুর্থ বছরে তৈরি। অতএব, তাঁর সিংহাসনারোহণ কাল হচ্ছে ১২৩০ খ্রীস্টাব্দ। এতে অনুমান করি মধুসূদন ও তার পুত্র বাসুদেব দশবছর কাল রাজত্ব করেছিলেন। অরি-রাজা চান্দর মাধব দামোদরদেবের অধিকার যে চট্টগ্রাম অবধি বিস্তৃত ছিল তা তার তাম্রশাসনেই প্রমাণ। দামোদরের পরবর্তী রাজা অরিরাজ দনুজমাধব দশরথদেব (ওফেঁ দনুজ রায়) সেনদের বিক্রমপুরাদি অধিকারেও আধিপত্য বিস্তার করেন। কিন্তু দশরথদেবকে আমরা (১২৮৩ খ্রীস্টাব্দে) গিয়াসুদ্দীন বলবনের প্রতি (সন্ধিসূত্রে?) আনুগত্য প্রদর্শন করতে দেখি। তাম্রপত্র সূত্রে মনে হয় হয়তো এই বংশেরই গোকুলদেব, নারায়ণদেব, কেশবদেব ও ঈশানদেব সম্ভবত সিলেট অঞ্চলে আরো অনেকদিন স্বাধিকার বজায় রেখেছিলেন।
অতএব এ আলোচনা থেকে আমরা নিম্নলিখিত তথ্যগুলো পাই :
ক. প্রাচীন সংস্কৃত-সাহিত্যে কিংবা তাম্রপত্রে চট্টগ্রামের নামও মিলে না। Strabo ও Periplus of the Erythrean sea থেকে জানা যায় চট্টগ্রাম খ্রীস্টীয় প্রথম শতকেও আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বন্দর ছিল।
খ. খ্রীস্টীয় চার-পাঁচ শতক অবধি আরাকান-চট্টগ্রাম একক অঞ্চলরূপে ছিল। এবং দশশতক অবধি আরাকানে চট্টগ্রামে মহাযান (সর্বাস্তিবাদী বা বিজ্ঞানবাদী) মত চালু ছিল। তবে তখনো ব্রাক্ষণ্যবাদ ম্লান হয়নি, প্রবলই ছিল। আনোরহটার রাজত্বকালে পর্গায় রাজকীয় সমর্থনে শিন অরহন গুরুবাদী মহাযান আরি মত উচ্ছেদ করে হীনযানী থেরবাদ ( গুরুবাদ) প্রবর্তন করেন। আনোরহটা (১০৪৪-৭৭) আরাকান ও চট্টগ্রামাদি অঞ্চল পট্টিকের-র সীমা অবধি জয় করে সেখানেও থেরবাদ চালু করেন।
গ. চট্টগ্রাম গোড়া থেকেই সম্ভবত আরাকানী শাসনে ছিল। আর নয়শতকের শেষপাদে ৮৭৭ অব্দের পূর্বে কোনো সময়ে সমগ্র সমতট আরাকানী শাসনভুক্ত ছিল। উক্ত সনে বৈশালীর (?) চন্দ্ররা আরাকানে ক্ষমতাচ্যুত হলেন আর পাট্টিকের অঞ্চলে সম্ভবত বৃক্ষচন্দ্রের বংশধর পূর্ণচন্দ্র ও তদ্বংশীয়রা গোটা সমতট বঙ্গ ও হরিখেলে রাজত্ব করতে থাকেন। ময়নামতীতে আরাকান রাজের মুদ্রা মিলেছে।
ঘ. সাত শতকে চট্টগ্রাম সমতটের খদঙ্গরাজ বংশের রাজ্যভুক্ত ছিল। ইৎসিঙ ও শেঙচির পর্যটনকালে রাজা ছিলেন রাজভট্ট। এ সময়–হিউএন সাঙের মতে-সমতটরাজ্য উত্তরে পুরোনো নিম্নব্ৰহ্মপুত্র নদ, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পশ্চিমে পদ্মানদী। খদঙ্গদের পরেই চন্দ্ররা রাজত্ব করেন।
ঙ. পাহাড়পুরে আট শতকের খলিফা হারুন-অর-রশিদের আমলের মুদ্রা মিলেছে। আরব বণিকেরা সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দর হয়েই বঙ্গ-কামরূপের অভ্যন্তরে বাণিজ্য করতেন এ অনুমান অসঙ্গত নয়।