২। চন্দ্রবংশ নানা জায়গায় প্রাপ্ত তাম্রপত্র ও মূর্তিলিপির প্রমাণে ও বিদ্বানদের বিশ্লেষণে সমতটের চন্দ্ররাজাদের একটি প্রায়-পূর্ণাঙ্গ নাম তালিকা ও রাজত্বের প্রায়-নিশ্চিত সময়কাল নির্ণিত হয়েছে। মনে হয়, গোপচন্দ্র সমাচারদেব এবং আদিত্য, দক্ষিণ বা নিম্নবঙ্গে তথা হরিখেমণ্ডলে রাজত্ব করতেন। আর খড়্গরা করতেন সমতটে। সম্ভবত খঙ্গদের পতনের পরে সমতট আরাকানের চন্দ্ররাজাদের অধিকারে আসে। আরাকানীসূত্রে দেখা যায়, বৈশালী নগরের চন্দ্ররা ৭৮৮ খ্রীস্টাব্দে রাজ্যচ্যুত হয় এবং উত্তর আরাকান সম্ভবত মহাবীর ও তার পরবর্তী রাজাদের দখলে থাকে এবং সমতট অঞ্চলে হয় বিতাড়িত চন্দ্ররা অথবা তাদের জ্ঞাতি সামন্ত-শাসক বংশীয়রা প্রায় দেড়শ বছর অবধি রাজত্ব করতে থাকেন। বাঙলায় প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণাদির সাহায্যে তাদের রাজপরম্পরার একটি পীঠিকা দেওয়া হল :
রাজা —রাজত্বকাল –খ্রীস্টাব্দ ——–মন্তব্য
১ পূর্ণচন্দ্র — আনু ৪০ — ৭৮৮-৮২৮ — রাজধানী পাটিকের
২ সবর্ণচন্দ্র – ঐ– ৮২৮-৮৬৮ – ঐ
৩ তৈলোক্যচন্দ্র — ঐ– ৮৬৮-৯০৮ হরিকেল মণ্ডল পতি, কান্তিদেব এঁর আশ্রিত ছিলেন।
৪ শ্ৰীচন্দ্র – ঐ– ৯০৮-৯৪৮ — দিগ্বিজয়ী, রাজ্যসীমা বিস্তৃত করেন, দ্বিতীয় গোপাল তার হাতে পরাজিত হন।
৫ কল্যাণচন্দ্র — নিশ্চিত রাজত্বকাল ২৪, আনু ৩৫ — ৯৪৮-৯৮৩ — বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করেন।
৬ লড়হচন্দ্র — নিশ্চিত : ১৮, আনু. ২৫ — ৯৮৩–১০০৮
৭ গোবিন্দচন্দ্র — নিশ্চিত ২৩, আনু. ৩০ — ১০০৮-১০৩৮ — ইনি চোলরাজ রাজেন্দ্র কর্তৃক (১০২১-২৩ সনে) পরাজিত হন।
৮ আত্মীয় ললিতচন্দ্র — আনু. ৩২ — ১০৩৮-১০৭০
বৈদ্যকশাস্ত্র গ্রন্থ বৃক্ষায়ুর্বেদ, লৌহসর্বস্ব ( লৌহ পদ্ধতি) ও শব্দপ্রদীপ লেখক এবং রাজা ভীমপালের চিকিৎসক সুরেশ্বর বা সুরপালের পিতা ভদ্রেশ্বর রাজা রামপালের (১০৭৭-১১২০) এবং তার পিতামহ দেবগণ গোবিন্দচন্দ্রের চিকিৎসক ছিলেন। এই ভিত্তিতে গোবিন্দ চন্দ্রের রাজত্বকাল ১০৫০ খ্রীস্টাব্দ অবধি অনুমান করা সম্ভব। সম্ভবত রাজা দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭০-৭৫) চন্দ্রদের সমতট রাজ্যের অধিকাংশ জয় করেন। এঁর বাঘাড়াউড় মূর্তিলিপিই সমতট অঞ্চলে পাল প্রভাবের প্রথম সাক্ষ্য বহন করে। ৫৪ পূর্ণচন্দ্রাদির আমলে বৃক্ষচন্দ্রাদিই হয়তো চট্টগ্রামের সামন্ত শাসক ছিলেন।
.
৩। হরিখেল
হরিখেল মণ্ডল এলাকা আজো অনির্ণিত। ইৎসিঙের (৭ম শতকের শেষার্ধ) মতে হরিখেল ভারতের পূর্ব প্রত্যন্ত অঞ্চল। কর্পূরমঞ্জরী লেখক রাজশেখরদত্ত (৯ম শতক) হরিখেলকে পূর্বদেশ বলেই পরোক্ষভাবে নির্দেশ করেছেন।৫৫ যশোধারার জয়মঙ্গলে আছে : বঙ্গালোহিত্যাং পূর্বেন। এসব গুলোই কামরূপ ও সমতট মধ্যস্থ শ্রীহট্টকে নির্দেশ করে।
আবার যাদবানন্দ কবিরাজের রসরূপচিন্তামনি (১৫৯৩ খ্র.) বাসুদেব কবিকঙ্কন চক্রবর্তীর রুদ্রাক্ষ মাহাত্মে (পাণ্ডুলিপি: ঢা. বিশ্ববিদ্যালয়) এবং কেশব কৃত্যসরের কল্পদ্রতে ও আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পে শ্রীহট্টকেই হরিখেল বলে নির্দেশ করা হয়েছে ৫৬
কিন্তু চীনাসূত্রে এও জানা যায় যে সমতট ও উড়িষ্যার মধ্যবর্তী হরিখেল কোনো উপকূল অঞ্চল। হেমচন্দ্রের অভিধান চিন্তামনি গ্রন্থে বঙ্গাস্তু হরিখেলিয়: উক্তিতে বঙ্গকেই হরিখেল বলা হয়েছে। আবার নয়শতকের হরিখেল মণ্ডলপতি কান্তিদেবের অসম্পূর্ণ তাম্রলিপি পাওয়া গেছে চট্টগ্রামে। তাতে দেখা যায় তার রাজধানী ছিল বর্ধমানপুর। এই বর্ধমানপুরের কোনো ঐতিহ্য সিলেটে কিংবা দক্ষিণবঙ্গে মেলে না। শ্রীচন্দ্রের রামপালে প্রাপ্ত তাম্রপত্রেও হরিশেলের উল্লেখ আছে।
অতএব (ক) সিলেট (খ) ফরিদপুর-বরিশাল-খুলনা প্রভৃতি উপকূল অঞ্চল (গ) চট্টগ্রাম (ঘ) ঢাকা-ময়মনসিংহ এলাকা–এর যে-কোনো একটি হরিখেল বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে খেল < কেল যদি < কের থেকেই হয়ে থাকে তাহলে পাটিকেরর যে-কোনো একপাশেই হরিখেল বিদ্যমান ছিল। আমাদের মনে হয়, দক্ষিণবঙ্গের উপকূলাঞ্চলই হরিখেল ছিল, এখান থেকেই কান্তিদেব সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম জয় করেন, কিন্তু সমতট রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের কাছে পরাজিত হওয়ায় তার তাম্রপত্রটি চট্টগ্রামে অসম্পূর্ণই থেকে যায়। এদিকে দক্ষিণবঙ্গ (চন্দ্রদ্বীপাদি) জয় করে ত্রৈলোক্যচন্দ্র রাজ্যসীমা বিস্তৃত করায় পাটিকের থেকে বিক্রমপুরে রাজধানী স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়েছিল। দ্বিতীয় গোপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপালের সময় দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ চন্দ্ররাজাদের অধিকারে ছিল। ত্রৈলোক্যচন্দ্র যখন বিক্রমপুরে রাজধানী করেন, তখন তার সামন্ত কুসুমদেব বা তার পিতা পাটিকের অঞ্চল শাসনের ভারপ্রাপ্ত হন। এরই সন্তান ভাবুদেব লড়হ চন্দ্রের সময়ে কারমন্তার শাসক ছিলেন–নটেশ্বর শিবের মূর্তিলিপি থেকে তাই অনুমান করা যায়। চন্দ্ররাজারা দক্ষিণ-দেশীয় রাজাদের দ্বারা বারবার পর্যদস্ত হন। রাজেন্দ্র চোল (১০২১-২৩) গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেন বলে তিডুমালাই লিপি থেকে জানা যায়, আবার কালকুচি রাজারাও চন্দ্ররাজ্যে বারবার হানা দেন। কোক্কলু (আনু. ৮৪০-৯০) ও তার পৌত্র লক্ষ্মণ রাজা এবং পরবর্তী কালকুচি রাজা কর্ণ (১০৪১-৭০) বঙ্গরাজার উপর জয়ী হয়েছিলেন। বাঘাউড়া লিপির প্রমাণে জানা যায় দ্বিতীয় মহীপাল সমতটের কতেকাংশ জয় করেছিলেন। কিন্তু এ জয় স্থায়ী হয়নি। ইনি কর্ণ-বিধ্বস্ত বঙ্গ-সমতট জয় করবার সুযোগ পেলে রক্ষা করতে সমর্থ হননি বলেই মনে হয়। কেননা আমরা দেখতে পাচ্ছি পূর্ববঙ্গরাজ জাতবর্মণ কালকুচিরাজ কর্ণের কন্যা বীরশ্রীকে বিয়ে করেছিলেন। কাজেই মহীপালের বিজয়ের সময় কর্ণ ও জাতবর্মণ উভয়েই জীবিত।