জিজ্ঞাসা করলাম, ওই মেয়েরা কারা?
-আমার কাছেই থাকে, আর আমাকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করে। বড় ভালো মেয়েগুলো। কিন্তু ওদের এক-একজনের কথা শুনলে তুমি হয়তো এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে সোজা কলকাতার গাড়িতে চেপে বসবে।
যা বোঝার এটুকু থেকেই বোঝা গেল।
আমরা সামনে আসতে মেয়েগুলো উঠে দাঁড়াল। তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধার পাত্রটি অমন হাসিমুখে এতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে আঙিনা পাড়ি দিল, তলায় তলায় হয়তো সেই কৌতূহলও আছে।
সুলক্ষণা বলল, এই মেয়েরা, কাকে দেখে তোরা হাসাহাসি করছিলি! কলকাতার একজন নামকরা লেখক। বামুন মানুষ, প্রণাম কর।
আমার অস্বস্তির একশেষ। ওরা একে একে পা ছুঁয়ে প্রণাম সারল। আমার দিকে চেয়ে সুলক্ষণা হেসে জিজ্ঞাসা করল, আমিও ঠুকব নাকি একটা?
গম্ভীর মুখে আমি আঙুল দিয়ে নিজের পা দেখিয়ে দিলাম। ও ছদ্ম কোপে ফোঁস করে উঠল, উঃ! বয়ে গেছে
আগন্তুক দেখে ভিতর থেকে আরো তিন-চারটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব না হোক, এরাও মোটামুটি সুশ্রী। আর বয়েস বাইশ থেকে ছাব্বিশের মধ্যে। আমি বাঙালী লেখক পরিচয় পেলেও আমার সঙ্গে তাদের সুলক্ষণাদিদিটির সম্পর্ক কি এরা জানে না। আর সুলক্ষণারও আর বেশি পরিচয় দেবার উৎসাহ দেখা গেল না। সকলের উদ্দেশেই সে বলল, চা কর, তোরাও খা আমাদেরও দে–এঁর জন্যে একটু খাবার-টাবারও করিস। আমাদের আজ বাইরে কোনো প্রোগ্রাম নেই তো?
ওরা মাথা নাড়ল। নেই।
–বাঁচা গেল। আমি এঁকে নিয়ে একটু ঘরে বসছি, সময় হলেই ডাকিস
কিসের সময় হলে কেন ডাকবে বোঝা গেল না। দিনের আলো এখন শেষ প্রায়। টালির ঘরগুলোতে আলো জ্বালা হয়েছে। একটি পরিচারিকা ঘরে ঘরে লণ্ঠন রেখে যাচ্ছে দেখলাম।
আমাকে নিয়ে সুলক্ষণা দাওয়ার সামনের ঘরটাতেই ঢুকে পড়ল। পাশাপাশি একই সাইজের চারটে ঘর। তারপর শেষের দিকে আর একটা বড় হলঘরের মতো। টালির ছাদ হলেও ঘরের মেঝে সিমেন্টের, আর ইট-সুরকির দেয়াল। পরিষ্কার তকতকে ঘর। দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেণ্ডারে গোপালের মূর্তি। কোণের দিকে একটা নেয়ারের খাঁটিয়া পাতা। তাতে পরিচ্ছন্ন সাদাসিধে শয্যা বিছানো। আলনায় খান-দুই শাড়ি আর জামা ঝুলছে। এদিকের দেয়ালে একটা আয়না টাঙানো।
কোথাও এতটুকু আতিশয্য নেই। এ-রকম একটা ঘরে এসে দাঁড়ালে ভিতরটা আপনা থেকে খুশী হয়।
সুলক্ষণা জানালো, এটা তার ঘর। এতগুলো মেয়ের মধ্যে শুধু তারই একলার। একখানা ঘর। অন্য ঘরগুলোর এক- একটায় তিন-চারটে করে মেয়ে থাকে।
রসিকতা করে বললাম, প্রমীলারাজ্যে এসে গেলাম মনে হচ্ছে।
হেসে মাথা নেড়ে সুলক্ষণা, সায় দিল। বলল, সমস্ত বাড়িতে পুরুষও একজন আছেন–তিনি গোপাল। আর দ্বিতীয় পুরুষ তুমি এলে।
বললাম, গোপালের তাতে হিংসে হবে না?
–একটু হলেই বা, সেও তো খুব সুবিধের পুরুষ নয়। হাসিমুখে একটা আসন। টেনে নিয়েও থমকালো একটু, তারপর হেসে আসনটা আবার যথাস্থানে রাখতে রাখতে বলল, যাকগে, তুমি ওই বিছানাতেই বসো-গোপালের আর একটু বেশি হিংসে হোক!
আমিও ঠাট্টা করলাম, ঠাকুর দেবতার হিংসে কুড়িয়ে কাজ কি!
–আচ্ছা তুমি বসো তো, ঠাকুর দেবতা আমি মেয়েটা কেমন ভালো করেই চেনে।
শয্যার এক ধারে বসলাম। একটা ভাজ করা কম্বলের ওপর চাদর বিছানো। নিজেকে নিয়ে ও অনায়াসে যে ইঙ্গিত করল, সেটুকুর জন্যেই আমার বাইশ বছরের ক্রোধ আর পরিতাপ। অথচ আশ্চর্য, সব জানা থাকা সত্ত্বেও সুলক্ষণার দিকে চেয়ে আমার বার বার মনে হচ্ছিল, একটা শুচিতা যেন ওকে ঘিরে আছে।
ও সামনে এসে দাঁড়াল। চাউনিটা গভীর একটু।
–কি দেখছ?
–তোমাকে। সেই বাইশ বছর আগের মতোই কাঁচা কাঁচা লাগছে। বিয়ে করেছ শুনেছি–বউ কেমন?
হেসে জবাব দিলাম, বিয়ে তো সেই কোন যুগে করেছি–এখন আর কেমন-এর কি আছে?
চোখ পাকালো।–তার মানে বউ পুরনো হয়ে গেছে? হাসলও সঙ্গে সঙ্গে। –ছেলে মেয়ে পড়ছে?
মাথা নাড়লাম।
ও ছেলেমানুষের মতোই বলে উঠল, আমার ছুটে গিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে করছে!
–চলো না!
–ইস, কি পরিচয় দেবে?
–বলব, তোদের অদেখা অনেককাল আগের এক হারানো মাসি।
হেসে উঠে লঘু সুরে সুলক্ষণা বলল, কেন পিসী বলবে না?
বাইশ বছরের সঠিক ইতিবৃত্ত কিছুই জানি না। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যেই আমার ভালো লাগছে, হালকা লাগছে। মাথা নাড়লাম, নাঃ, অতটা নীরস হতে পারব না।
সুলক্ষণা হাসছে। চেয়ে আছে। বললাম, বসো
তেমনি চেয়ে থেকেই রসিকতা করল, এক্ষুনি চা দিতে আসবে, তুমি ওখানে বসে আছ দেখেই অবাক হবে, পাশে আমাকে দেখলে তো কথাই নেই। সামনে দাঁড়িয়েই ভালো লাগছে। জয়ন্ত বলছিল, অনেক নাকি বই-টই লিখেছ?
–লিখেছি।
–কি বই?
–গল্প, উপন্যাস।
টিপ্পনীর সুরে একটু বিস্ময় প্রকাশ করল সুলক্ষণা, তোমার মধ্যে এত রস আছে জানতাম না।…দু-একখানা পাঠাও না, এককালে তো আমাকে বাংলা শেখানোর কি ঝোঁক ছিল তোমার–ঠেকে ঠেকে ঠিক পড়ে নিতে পারব।
–হিন্দী অনুবাদও আছে, তাই পাঠাব, ঠেকে ঠেকে পড়তে হবে না।
সুলক্ষণা ছেলেমানুষের মতোই খুশী হয়ে উঠল। মুখে বলল, তুমি এখান থেকে বেরিয়েই ভুলে যাবে। বাইশ বছরের মধ্যে একদিনও আমার কথা মনে পড়েছে?
–তোমার পড়েছে?
–আমার! হু। তাহলে তো খুব উপন্যাস লেখো তুমি! কি মনে হতেই আবার হাসি-আমার গল্প লিখবে না?