-কিন্তু এই দিয়েই তোমাদের এতগুলো মেয়ের দিন চলে যায়?
হয়তো এই প্রশ্নে তির্যক কটাক্ষ ছিল একটু। কিন্তু সুলক্ষণা দয়ালের একটা পরিবর্তন স্পষ্ট। আগের মতো সহজে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে না, ঝলসে ওঠে না, হয়তো বা অনেক নিগ্রহের পরে এই সংযমটুকু আয়ত্ত করেছে। যাক, আমার কথার জবাবে ও যা বলল, সেও অবাক হবার মতোই। সপ্তাহে কম করে তিন-চারদিন বাইরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গানের প্রোগ্রাম থাকে তাদের। হরিদ্বারে কোথাও না কোথাও সে রকম অনুষ্ঠান লেগেই আছে। সবার আগে তাদেরই ডাক পড়ে। সুলক্ষণাদের বিশেষ কিছু দাবিদাওয়া নেই, যারা যেমন দেয়। এখন নাম হয়েছে বলে খুব কমও দেয় না কেউ। এমন কি হরিদ্বারের বাইরেও বহু জায়গায় গাইতে যেতে হয়। দিন বেশ ভালোই। চলে যায় তাদের, অভাব-টভাব নেই।
জিজ্ঞাসা করলাম, এই গানের দল তুমি কতদিন গড়েছ?
একটু ভেবে নিয়ে ও বলল, তা প্রায় বছর নয় হবে।
এবারে আমি সত্যিই অবাক একটু। নবছর আগে হলে তখন তেত্রিশ চৌত্রিশ হবে ওর বয়েস। এখন যা দেখছি, সে-সময় নিশ্চয় ওর ভরা যৌবন, ভরা রূপ। সব ছেড়ে সেই সময় থেকে ও গোপাল আশ্রয় করেছে–এটা স্বাভাবিক ব্যাপার নয় আদৌ। আমি চেয়ে আছি, ওর মুখ থেকেই সেই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা টেনে বার করতে চেষ্টা করছি। শেষে বলেই ফেললাম, ও-বয়সে এ-রকম তো হবার কথা নয়, গোপাল এমন টানা টানলে, কি ব্যাপার?
মুখের দিকে চেয়ে টিপটিপ হাসতে লাগল। তারপর বলল, গোপাল টানলে এমনিই হয়।…তখন ভর-ভরতি অবস্থা আমার, পায়ে করে পুরুষের মন মাড়িয়ে যেতেই আনন্দ, তারই মধ্যে কি কাণ্ড–একেবারে চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে নিজের পায়ে মুখটা আচ্ছা করে ঘষে দিয়ে তবে ছাড়লে–ছাড়লেই বা বলছি কেন, এখনো এই দুষ্টুমিই চলছে।
শুনতে ভালো লাগছে, কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। আমি চেয়েই আছি।
আত্মস্থ হয়ে সুলক্ষণা বলল, অত ব্যস্ত কেন, সব শোনাব বলেই তো ধরে রেখেছি। রোসো, নিজের ভিতরটা আরো ভালো করে খুঁজে দেখে নিই আগে
হেঁয়ালির মতো লাগল। ভিতরের তাগিদ সত্ত্বেও আর জোর করলাম না। কি মনে হতে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার এই মেয়েদের পেলে কোথায়?
নিঃসঙ্কোচে সুলক্ষণা দয়াল জবাব দিল, নিজে থেকেই এসেছে, আগে মাত্র একটি চেনা মেয়ে ছিল, এখন ওরা নজন।…সবই আমার মতো, কেউ নিজে ভুল করেছে, কাউকে বা জোর করে ভুল করানো হয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম, ওদেরও ভিতর-বার এখন গোপালের পায়ে?–
হেসে ফেলল।তাই যাতে হয় আমি তো চেষ্টা করি, আর নেবার আগে যতটা পারি যাচাই বাছাই করে নিই। তবু গণ্ডগোল কি হয় না, এ-পর্যন্ত দু-দুটো মেয়ে ফের আবার লোভে পড়ে এখান থেকে সরে গেছে–আর তোমাদের পুরুষের লোভও বলিহারি, ঠাকুরঘরে থাকো আর যেখানেই থাকো, জাল ফেলার কামাই নেই, পুণ্যিস্থানে। যেন আরো বেশি পাপের বাসা।
সুলক্ষণার সঙ্গে দেখা হবার পরেও চার দিন চার রাত হরিদ্বারে ছিলাম। বলতে গেলে দু বেলাই ওদের এখানে এসেছি। বাড়ির বাইরে দুদিন গানের প্রোগ্রাম ছিল সেখানে ও গেছি। এখানকার মেয়েরা আমাকে শুভার্থী আত্মায় ভেবেছে। সুলক্ষণা তাদের কি বলেছে জানি না, কিন্তু আমার প্রতি তাদেরও কোনো রকম পলকা কৌতূহল। দেখিনি। উল্টে অবিমিশ্র শ্রদ্ধাই দেখেছি।
ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথা হয়েছে সুলক্ষণার সঙ্গে, কিন্তু একটি বারও সে এর মধ্যে কৃষ্ণকুমারের বা তাদের বাড়ির কারো নামও উচ্চারণ করেনি। ক্রমে আমারই ধৈর্য কমে আসছিল। ফঁক পেলেই তাগিদ দিচ্ছি, বলবে বলেও তো কিছুই বললে না–এবার যেতে হচ্ছে আমাকে।
গতকালও বলেছিলাম। ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে একটু চেয়ে থেকে ঝাঁঝ দেখিয়েছে, আমি কি তোমাকে ধরে রেখেছি?
বলেছিলাম, তা অবশ্য রাখোনি–
তেমনি করেই ও আবার বলেছিল, পুরুষের স্বভাবই ওই রকম, এতবড় দেবস্থানে। এসেও নরকের কথা শোনার লোভ।
আমি হেসেই জবাব দিয়েছিলাম, নরকের কথা তো নয়, নরক থেকে ওঠার। কথা। সেটা শোনার মধ্যে পুণ্যি আছে।
–ছাই আছে। ওঠা তো ভারি, এই যে তুমি চলে যাবেই, তোমার বাড়ি-ঘর স্ত্রী ছেলেমেয়ে আছে–অথচ তোমাকে সত্যি ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে।
দু কান ভরে শোনার মতো কথা, একটু চুপ করে থেকে বলেছিলাম, করলেই বা, এ ইচ্ছের মধ্যে তো নরক নেই।
..ওর চোখেমুখে যে সুন্দর হাসিটুকু দেখেছিলাম তাও ভোলার নয়।
আজ সকালে আবার বললাম, কাল সকালে আর না গেলেই নয়, কাজের খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে–রিজারভেশান পেলে সোজা এখান থেকে কলকাতাই চলে যাব।
সুলক্ষণা বলল, ঠিক আছে, নাম-গানের দৌলতে আমার একটু চেনা-জানা আছে, একেবারে অসম্ভব না হলে রিজারভেশান পেয়ে যাবে।
সন্ধ্যেয় রিজারভেশানের টিকিট আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, নিশ্চিন্ত?
আমিও হেসেই মাথা নাড়লাম।
এই রাতটুকুই প্রত্যাশা আমার। ছিলামও রাত প্রায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত। কিন্তু এ-দিন দেখলাম একলা পাওয়াই ভার ওকে। মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত, আমার খাওয়ার ব্যাপারে ব্যস্ত। কাল ট্রেনে আমার সঙ্গে কি কি খাবার যাবে–মেয়েদের সেই নির্দেশও দিচ্ছে।
রাতে হোটেলে ফেরার মুখে ওকে কাছে দেখলাম না। একটি মেয়ে বলল, দিদি এইমাত্র তার ঘরে গেলেন–
পায়ে পায়ে তার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভিতরে এসে দাঁড়ালাম। স্টীলের বাক্স খুলে ওদিক ফিরে কিছু একটা করছে ও।