-না। বিরক্তি চাপতে না পেরে প্রচ্ছন্ন ঝাঁঝে ক্ষুদ্র জবাব দিল শঙ্কর সারাভাই।
কিন্তু দিদিটির শঙ্কা যায় না তবু। ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। খটকা লেগেইছে, সেই সঙ্গে কিছু বোধহয় মনেও পড়ল তার। মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, মেসোমশাইয়ের কাছ থেকে আবার টাকা আনিসনি তো?
এদিকের ধৈর্য গেল। তিক্ত বিরক্ত হয়ে শঙ্কর সারাভাই বলে উঠল, এনেছি তো, না আনলে টাকা পাব কোথায়, আমাকে ধার দেবার জন্যে কে হাত বাড়িয়ে বসে আছে?
যশোমতী খাওয়া ছেড়ে উঠে পালাতে পারলে বাঁচে। বাইরের কারো সামনে এই আলাপও যে কেউ করতে পারে তার ধারণা ছিল না। কিন্তু এরপর যা শুনল, তার চক্ষুস্থির।
দিদির মুখেও বিরক্তির ছায়া ঘন হতে লাগল। ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।–ফের তুই মিথ্যে কথা বলে টাকা এনেছিস?
সঙ্গে সঙ্গে ভাই চিড়বিড় করে উঠল।–সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হলে মেসো টাকা দেবে? নাকি টাকা ছাড়া চলবে? ওদিকে তো কাজ একরকম বন্ধ, সুতো নেই, মেশিন ভাঙা, ছাদ দিয়ে মাথার ওপর জল পড়ছে–কাপড় নানো ছেড়ে ওই তাঁতে গামছা পর্যন্ত তৈরি করা যাচ্ছে না।
দিদিটির মুখের দিকে চেয়ে ঘাবড়েই যাচ্ছে যশোমতী। হারিকেনের অল্প আলোয়ও বোঝা যায় মুখখানা তেতে উঠেছে। বলে উঠল, তা বলে তুই ভাওতা দিয়ে টাকা আনবি, একবার ওই করে শিক্ষা হয় নি? কালই আমি মাসিমার কাছে চিঠি লিখে জানিয়ে দিচ্ছি সব।
শঙ্কর বলল, তুমি না লিখলেও দু’দিন গেলেই তারা বুঝতে পারবে।
–পারুক, তরু লিখব। ছি ছি ছি ছি, লজ্জায় মাথা কাটা গেল। না হয়, ক্ষেতের শাক-ভাত খেয়ে থাকব আমরা, টাকা মাথায় চাপলে তোর হয় কি শুনি?
ভাই হুমকি দিয়ে উঠল, খেতে দেবে, না সব ফেলে উঠে চলে যাব?
সুর নরম হওয়া দূরে যাক, সঙ্গে সঙ্গে দিদিটিরও সমান উগ্রমূর্তি। –যা দেখি কেমন আস্পর্ধা তোর! আর-একবারের সেই হাতে-পায়ে ধরার কথা ভুলে গেছিস, কেমন?
যশোমতীর দুই চক্ষু বিস্ফারিত। সে যেন চোখের সামনে নাটক দেখছে কিছু। ওদিকে ক্ষুদ্র শিশুটির কোনরকম ভাববিকার নেই। সে যেন মা আর মামার এ-ধরনের বিবাদ শুনে অভ্যস্ত। নিবিষ্ট মনে খাচ্ছে এবং এক খাওয়া ছাড়া আর কিছু তার মাথায় নেই। একটু নীরবতার ফাঁক পেয়ে বলল, মা, আর একটা ভাজি দেবে?
মায়ের এইবার খেয়াল হল বোধহয়। বাইরের মেয়ে এই ঘরের কথাবার্তা শুনে কাঠ হয়ে বসে আছে। ছেলের পাতে ভাজা দিয়ে যশোমতীর দিকে ফিরল।–কি হল, তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছ দেখি। তুমি এ-সব শুনে কিছু মনে কোনো না বাছা–গরীবের ঘরের সতেরো জ্বালা, তার ওপর ওই অবুঝ ছেলে এমন এক-একটা কাণ্ড করে বসে যে মাথা ঠিক থাকে না।
যশোমতী আড় চোখে দেখল অবুঝ ছেলে ঘাড় গোঁজ করে খাচ্ছে। দিদি জিজ্ঞাসা করল, আর কি দেব বলে
যশোমতী তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল, আর কিছু চাইনে।
.
রাতের শয্যা নেবার পর আর চিন্তা করা গেল না কিছু। সমস্ত দিনের ক্লান্তি আর চিন্তার ধকলে স্নায়ুগুলো সব নিস্তেজ। কোন পর্যায়ের দারিদ্র্যের সঙ্গে যে এরা যুদ্ধ করছে সেটা ভাবতে ভাবতেই চোখ বুজে এলো যশোমতীর। তার আগে মনে মনে একটা ব্যাপার অনুভব করে কেমন একটু স্বস্তিও বোধ করেছে সে। ভাইটির মেজাজ যত তিরিক্ষিই হোক, বোনের কাছে ঢিট সে। এটা তার যেমন মন্দ লাগে নি, ছল-চাতুরী করে কোন এক আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা আনা হয়েছে শুনে তেমনিই আবার খারাপ লেগেছে।
শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের কোণে স্তিমিত হারিকেন জ্বলছে তখনো। বাইরে কোথায় শেয়াল ডাকছে। ছোট একটা জানলা খোলা, বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাতে গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল। চোখ বুজেই বিছানায় পড়ে রইল যশোমতী। সকাল হলে কি করবে সে, মেয়ে-পাঠশালায় চাকরির চেষ্টায় যাবে? তারপর? কালই চাকরি হবে সে-রকম আশা করার কোনো কারণ নেই। চাকরি না হলে কি করবে? আবার এই দারিদ্রের সংসারে ফিরে আসবে। এখান থেকে যেতে হলেও টাকা লাগবে, এক-আধখানা গয়না এখানে বিক্রি করার সুবিধে হবে কিনা কে জানে। আর এত বিড়ম্বনার পর ভাগ্য যদি তার একটু ভালই হয় অর্থাৎ, মেয়ে পাঠশালায় চাকরি যদি পেয়েই যায় তাহলেই চাকরি হলেই বা কি করবে? থাকবে কোথায়? পরক্ষণে নিজেকেই আবার চোখ রাঙাতে চেষ্টা করল যশোমতী, সমস্যা তো সর্বত্রই আছে। অত ভাবলে বাড়ি থেকে বেরোতে গেছল কেন?
ভাবতে ভাবতে আবার কখন চোখ বুজে এসেছিল। চোখ খুলে দেখে সকাল। প্রথম মনে হল বাড়ির শয্যায় শুয়েই কিছু একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে উঠল সে। চোখ মেলে তাকানোর পরেও সে স্বপ্নের রেশ কমে নি যেন। তারপরেই টের পেল স্বপ্ন নয়। কঠিন বাস্তবের মধ্যেই পড়ে আছে। বিচিত্র বাস্তব। তবু জানলার ভিতর দিয়ে দুরের আকাশ আর প্রথম ভোরের দিকে চেয়ে অদ্ভুত লাগল। প্রকৃতি যেন শুচি-স্নান করে উঠল এইমাত্র।
বিছানা ছেড়ে উঠল যশোমতী। ঘরের কোণের হারিকেনটা নিভিয়ে দিল। পরা শাড়িটা একটু গোছগাছ করে নিয়ে দরজার খিল খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল।
প্রথমেই যে বস্তুটা তার চোখে পড়ল, সেই বস্তুরই আর-একটার অর্থাৎ দ্বিতীয়টার খোঁজে এদিক-ওদিক তাকালো সে। তারপর বিড়ম্বনার ছায়া পড়ল মুখে।
স্যাণ্ডাল। তার শৌখিন স্যাণ্ডালজোড়ার দ্বিতীয় পাটি অদৃশ্য। রাত্রিতে শোবার সময়ে ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে দরজা টেনে দিয়েছে, হারিকেনের স্বল্প আলোয় স্যাণ্ডালজোড়া চোখে পড়ে নি। অলক্ষ্যে সে দুটো বাইরেই থেকে গেছে। এখন তার একটা পড়ে আছে, আর একটা নেই। এদিক-ওদিক খুজল একটু। কুকুর বা শেয়ালের কাণ্ড ছাড়া আর কি!