মেসোর চোখে-মুখে সমস্যা সমাধানের উদ্দীপনা। স্ত্রীর চোখে এত সহজে ধুলে দেবার রাস্তাও আছে কল্পনা করতে পারে নি। শুধু ধূলো দেওয়া নয়, একেবারে নিজেকে বাঁচিয়ে ধূলো দেওয়া। কিন্তু সমর্থনসূচক আনন্দটা ব্যক্ত করার মুখেই আবার বাধা। সামনের হাফ-দরজার ওধারে দুটো পা দেখা গেল—দরজা ঠেলে কেউ প্রবেশোত। শঙ্করের আগের কথায় তোক বা টাকা পাওয়ার সম্ভাবনার গরমে হোক, মেসো দরজার দিকে চেয়ে হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে উঠল।-হু ইজ দেয়ার সময় নেই অসময় নেই যতসব-বেয়ারা।
গর্জনটা যে এমন জোরালো হয়ে উঠবে শঙ্কর ছেড়ে মহাদেব সারাভাই নিজেও ভাবে নি বোধকরি। আচমকা হুঙ্কারে ঘরের বাতাসসুদ্ধ ভারি হয়ে গেল বুঝি। কিন্তু হাফ-দরজা খুলেই গেল তবু। আর ঘরে এসে যে দাঁড়াল তাকে দেখামাত্র ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল মেসো। তারপরেই বিবর্ণ পাণ্ডুর সমস্ত মুখ। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ফুট গোঁ-গোঁ শব্দে বলতে চেষ্টা করল, সা-সা-সা-সার।
ঘরে ঢুকেছে চেম্বারের চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখর পাঠক। কিন্তু শর তাকে চেনে না। মেসোর আর্ত মুখভাব দেখে সে-ও বিমূঢ় নেত্রে চেয়ে রইল শুধু।
চন্দ্রশেখর পাঠক সামনে এগিয়ে এলো। মন্থর গতি। হাত দুটো প্যান্টের পকেটে। চোখের কোণ দিয়ে একবার সামনের লোককে অর্থাৎ শঙ্করকে দেখে নিল। তারপর টেবিলের এধারে মেসোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃদু গম্ভীর স্বরে বলল, এত গরম কিসের, ভেরি বিজই?
আবারও শুধু সা-সা ভিন্ন আর কোনো আওয়াজ বেরুলো না মেসোর গলা দিয়ে। যাবার পথে অফিস-সংক্রান্ত কিছু একটা কাজের কথা বলার জন্যই ঘরে ঢুকে পড়েছিল চন্দ্রশেখর পাঠক। বাইরের লোক দেখে তা আর বলা গেল না। প্যান্টের হাত দুটো কোমরে উঠল, আবার ফিরে দেখলেন একবার। তবে উপস্থিতিতে এভাবে চেয়ারে বসে থাকার লোক বেশি দেখে নি।–হু ইজ হি?
শঙ্করকে চেয়ারে আরাম করে বসে থাকতে দেখে মেসোর দ্বিগুণ অস্বস্তি। বলল, আমার….মানে আমার ওয়াইফের….মানে আমার শালীর ছেলে সার।
বলা বাহুল্য, শালীর ছেলে দেখে বড়কর্তা আদৌ মুগ্ধ হল না। উল্টে তার চোখ পড়ল প্যাডের হিজিবিজি ছটার ওপর–শেয়ারের দাম ফেলে আঁক কষে শঙ্কর যা এতক্ষণ ধরে বুঝিয়েছে মেসোকে। তুঘোড় বুদ্ধিমান মানুষ বড়সাহেব, তার কেরামতিতে শেয়ারবাজার ওঠে নামে–এক পলক তাকিয়েই কিছু যেন বুঝে নিল। মহাদেব সারাভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে মৃদু অথচ বক্র শ্লেষে জিজ্ঞাসা করল, ডিড, আই ডিসটার্ব ইউ?
মহাদেবের মুখ পাংশু, তার পিছনের একটা হাত ক্রমাগত শঙ্করকে ইশারা করছে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে। কিন্তু হাঁ করে শঙ্কর অভিব্যক্তিসম্পন্ন আগন্তুকটিকেই দেখছে। আগন্তুক অফিসের হোমরা চোমরা একজন বুঝেছ, কিন্তু কে-যে ঠিক ধরে উঠতে পারছে না। শুকনো জিভে করে শুকনো ঠোঁট ঘষে মহাদেব সভয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়ল শুধু। অর্থাৎ একটুও ডিসটার্ব করা হয় নি। বড়সাহেবের মেজাজ জানে, কাগজে কি হিসেব হচ্ছিল যদি আঁচ করে থাকে, অর্থাৎ কোন্ তন্ময়তা ভঙ্গের ফলে সুপারিনটেনডেন্টের ক্ষণকাল আগের ওই গর্জন সেটা যদি টের পেয়ে থাকে, তাহলে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়াও বিচিত্র নয়। বড়সাহেবের রোষাগ্নিতে সত্যি সত্যি কাউকে পড়তে হয় নি কিন্তু পড়লে কি হবে সেই-ত্রাসে শঙ্কিত সকলে।
বড়সাহেব আর এক নজর শঙ্করকে দেখে নেবার আগেই টেবিলের টেলিফোন বেজে উঠল। এই টেলিফোন যে মুশকিল আসান, জানে না। তাড়াতাড়ি রিসিভার তুলে মহাদেব শুকনো গলায় সাড়া দিল। পরক্ষণে শশব্যস্তে বড়সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিল ফোন।
–আপনার সার….
হাত বাড়িয়ে রিসিভার নিয়ে এবারে বড়সাহেব সাড়া দিল। পরক্ষণে দুই ভুরু কুঁচকে যেতে দেখা গেল তার। অপ্রত্যাশিত কিছু যেন শুনল। তারপরেই ব্যস্ত হয়ে ওধারের রমণীর উদ্দেশে বলল, আচ্ছা, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। রমণী . কারণ মহাদেব বামাকণ্ঠই শুনেছিল মনে হল। ঝপ করে রিসিভার নামিয়ে রেখে দ্রুত ঘর ছেড়ে প্রস্থান করল বড়সাহেব। শঙ্কর সারাভাইয়ের মনে হল, ভদ্রলোক যেন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে চলে গেল।
কিন্তু মহাদেব সারাভাইয়ের কিছুই লক্ষ্য করার ফুরসত হয় নি। ভালো করে কাঁপুনিই থামছে না তার। ঘামে সমস্ত মুখ ছেড়ে জামা পর্যন্ত ভিজে গেছে। বড়সাহেব ঘর ছেলে চলে যেতে আর তারপর তার ভারি পায়ের শব্দও নিঃসংশয়ে মিলিয়ে যেতে অবসন্নের মতো ধুপ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল। তার অবস্থা দেখে শঙ্কর কি করবে বা কি বলবে ভেবে না পেয়ে উঠে রেগুলেটার ঘুরিয়ে পাখার স্পীড বাড়িয়ে দিল।
এই মুহূর্তে তার ওপরেই তিক্ত বিরক্ত মহাদেব সারাভাই। এই ছোঁড়া না এলে তো আজ এরকম বিভ্রাটে পড়তে হত না তাকে। আর এভাবে তাতিয়ে না দিলে অমন স্বভাববিরুদ্ধ গর্জনও করে উঠত না। তারপরেও নবাবপুত্তরের মতো চেয়ারে বসে থেকে এই সামান্য সময়টুকুর মধ্যে কম নাজেহাল করেছে তাকে! মুখবিকৃত করে বলে উঠল, বড়সাহেবকে দেখেও চেয়ারটা ছেড়ে একবার উঠে দাঁড়ালি না পর্যন্ত, বোকার মতো হাঁ করে বসেই রইলি।
মেসোর অবস্থা দেখে সন্দেহ আগেই হয়েছিল, তবু খোদ বড় সাহেবই যে মেসোর ঘরে এসে হাজির হয়েছে সেটা ধরে নেওয়া কঠিন। নিঃসংশয় হওয়া গেল। নাম-ডাকের মতোই রাশভারী চাল-চলন বটে। তবু নির্লিপ্ত মুখেই জবাব দিল, কে তোমার বড় সাহেব আর কে তোমার নিচের, কি করে বুঝব বলে–সকলেরই তো সমান হম্বিতম্বি তোমার ওপর। ….যাকগে, কি আর হয়েছে।