অর্চনা বসু ফিরে এলো যখন, টিচার্স-রুম ফাঁকা বললেই হয়। কল্যাণীদি এবং আর দুই-একজন আছেন। কল্যাণীদির দুশ্চিন্তার কারণ নেই, ইন্টারভিউ শেষ হলে কাকাই তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবেন, নয়তো বাড়ি ফিরে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। অবশ্য কাকার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকেন না তিনি, নিজের ছোট্ট আলাদা বাসা আছে। ভাই থাকে কাকার সঙ্গে। ঝড়জল দেখলে কাকা গাড়ি পাঠাতে ভোলেন না। আর যে দু-তিনজন টিচার বসে আছেন, তাঁরাও কল্যাণীদির কাকার গাড়ির আশাতেই আছেন।
এরই মধ্যে অর্চনা বসুকে ফিরতে দেখে কল্যাণীদি অবাক। অন্য সকলকেই এর থেকে অনেক বেশী সময় আটকে রাখা হয়েছিল। এ তো গেল আর এলো!
হয়ে গেল?
আগের চেয়ারটিতে বসে অর্চনা মাথা নাড়ল শুধু। বাইরের দিকে চেয়ে, ফিরবে কি করে সেই সমস্যাই তখন বড় হয়ে উঠেছে। ইন্টারভিউ প্রসঙ্গে কল্যাণীদি বা আর কারো আগ্রহ খেয়াল করল না।
কল্যাণীদি নিরাশ হলেন একটু। ইতিহাস-শিক্ষয়িত্রীর শূন্যস্থানে একেই আশা করেছিলেন তিনিও। কি জানি কেন মনে হয়েছিল একে পেলে ইস্কুলেরই লাভ আর বৃদ্ধি। কমিটির চারজনের মধ্যে দুজনেই তাঁর আপনজন, সে-কথা আভাসে ব্যক্ত করতেও লজ্জা। সে-ভাবে নিজেকে কোনদিনই জাহির করেন না তিনি। মেয়েদের ড্রইং টিচার পরিচয়েই খুশী। এমন কি গোড়ায় গোড়ায় এখানকার হেডমিসট্রেসও অনেকদিন জানতে পারেননি যে কল্যাণীদির বাবার নামেই এই ইস্কুল। আর জেনে লজ্জিতও হয়েছিলেন বড় কম নয়। কারণ সেক্রেটারির সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতে গিয়েছিলেন, মেয়েদের ভালমত ড্রইং শেখানোর জন্য পাস করা আর্টিস্ট নিয়ে আসা উচিত কি না। সেক্রেটারী বিব্রতমুখে বলেছিলেন, কেন, ও তো বড় ভাল আঁকে, বাড়িতে অনেক যত্ন করে শিখেছে–তাছাড়া ইস্কুলটার জন্যে সেই গোড়া থেকে করেছেও অনেক, ওরই বাবার ইস্কুল তো–মায়া খুব।
হেডমিসট্রেস বিব্রত হয়েছিলেন চতুর্গুণ। আলোচনা ছেড়ে পালিয়ে আসতে পথ পাননি। মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কেউ তাঁকে জানায়নি পর্যন্ত। আর আশা করেছেন কথাটা যেন চাপা থাকে।
কিন্তু চাপা থাকেনি। কথা-প্রসঙ্গে রামতারণবাবুই ভাইপোকে বলেছিলেন। নিখিলেশ দিদিকে ঠাট্টা করেছে, চাকরিটি যে এবারে গেল তোমার!
একগাল হেসে হেডমিসট্রেসকেই বলে এসেছেন কল্যাণীদি; এ চাকরি গেলে বাগানে জল দেবার কাজটা অন্তত দিতে হবে, ইস্কুল ছাড়তে পারব না … সানন্দে শিক্ষয়িত্রীদেরও না জানিয়ে পারেননি দুশ্চিন্তার খবরটা। বলেছেন, মালতীদিকে বলে এলাম চাকরি গেলে বাগানে জল দেব, হব মালাকর–এই যাঃ! মালাকর, না মালাকরী?
এ-হেন কল্যাণীদি অর্চনা বসুর চাকরি হওয়া সম্ভব কি না স্থির করতে না পেরে নিজের অগোচরেই ছোটখাটো ইন্টারভিউ নিয়ে ফেললেন আবার একটা। হালকা আলাপের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, বি-এ-তে অনার্স ছিল আপনার?
বাইরে থেকে চোখ ফেরাল অর্চনা। মাথা নাড়ল। ছিল না।
তাহলে আর কেমন করে হবে চাকরি। মনে মনে ভাবছেন কলাণীদি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে খটকাও বাধল, তাহলে ইন্টারভিউ পেল কি করে? দরখাস্ত বাছাই করে ইন্টারভিউতে ডাকা হয়েছে, চেহারা দেখে তো ডাকা হয়নি। তাহলে এম. এ. বোধহয়…।
আপনি এম, এ.?
এবারেও বাধা না দিয়ে অর্চনা মাথা নেড়ে জানাল, তাই। বাইরের দিকে তাকাল, চট করে জল থামার কোন সম্ভাবনা দেখছে না।
আবারও সমস্যা কল্যাণীদির। কেমন এম. এ.? হেডমিসট্রেসের বান্ধবী ক্যাণ্ডিডেটা মাঝারি এম. এ। তার ওপর মেয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে। …দু-পাঁচ মাসের অভিজ্ঞতার ভারি তো দাম! হেডমিসট্রেস তলায় তলায় কিছু কারসাজি করলেন কি না, চকিতে সে-সংশয় জাগল।
কিন্তু এদিকে যে কথাই বলে না, কি হল-না-হল বোঝা যাবে কি করে!
অবশ্য মুখ দেখে আঁচ করা যাচ্ছে খানিকটা। কিন্তু এই ইস্কুলের চাকরির ব্যাপারে এ ধরনের নিস্পৃহতা ভাল লাগে না কল্যাণীদির। বুঝতে যখন চেয়েছেন, না বুঝে অথবা না বুঝিয়ে ছাড়ার পাত্রীও নন মহিলা। তাঁর কৌতূহলে রাখা ঢাকা নেই। তাছাড়া বলতেও পারেন দিব্যি রসিয়ে মজিয়ে। বললেন, আমি ভাই ড্রইং টিচার এখানকার, বিদ্যেবুদ্ধি বুঝতেই পারছেন। এঁদের নাকি বি এ অনার্স নয়তো ভাল সেকেণ্ড ক্লাস এম. এ. চাই। আপনাকে দেখেই ভাল লেগেছে, আপনার হলে বেশ হয়। আপনি সেকেণ্ড ক্লাস তো?
এর পরের প্রশ্নটাই হত, কেমন সেকেণ্ড ক্লাস। কিন্তু সে প্রশ্নের আর অবকাশ পেলেন না কল্যাণীদি। তাঁর কথা শুনে অর্চনা বসু মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল একটু। তারপর মাথা নাড়ল, সেকেণ্ড ক্লাস নয়।
ও হরি। কল্যাণীদির ভাবনা-চিন্তা গেল। একটু যেন সঙ্কোচও বোধ করলেন, না তুললেই হত কথাটা। তাঁর ধারণা দ্বিতীয় শ্রেণীও নয় যখন, তৃতীয় শ্রেণী ছাড়া আর কি। কিন্তু যাকে জিজ্ঞাসা করেছেন তার হাসির মধ্যে যেন বিব্ৰত ভাব দেখালো না একটুও। চকিতে আবারও মনে হল। তৃতীয় শ্রেণী হলে তো ইন্টারভিউতে ডাকার কথা নয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় শ্রেণীর দরখাস্তের যেখানে অভাব নেই।
তাহলে? তাহলে আর যা সেটা ভরসা করে জিজ্ঞাসা করে ওঠাও সহজ নয়। চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকেন খানিক। একটাই মাত্র শ্ৰেণী মানায় বটে। শেষে বলেই ফেললেন ঝপ করে, তবে কি ফার্স্ট ক্লাস নাকি?
অর্চনা হেসেই ফেলেছিল।