কিন্তু অর্চনা বসু ঘরে ঢোকার সঙ্গে এ-সবই বেমালুম ভুলে গেলেন তিনি। শান্ত নম্র অভিবাদনের জবাবে বৃদ্ধটি তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন শুধু। সমবয়সী প্রফেসর বন্ধুটিও। নিস্পৃহমুখে গদি-আটা চেয়ারে গা এলিয়ে বসে ছিল নিখিলেশ। নিজের অগোচরে আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসল। যে-ভাবে বসে ছিল, সেই ভাবে বসে থাকাটা যেন অসম্মানজনক হত। এমন কি হেডমিসট্রেস মালতী রায়ও ভিতরে ভিতরে একটু বিব্রত বোধ করতে লাগলেন–একটু আগে তিনি যে প্যাঁচ কষেছিলেন, এই সাদার ওপর একটা কালো আঁচড় ফেলার মতই সেটা যেন অশোভন মনে হতে লাগল।
দু-চার মুহূর্ত নিষ্পলক চেয়ে থেকে ওই মুখে মহাশ্বেতার শুভ্র বেদনা পুঞ্জীভূত দেখলেন যেন সেক্রেটারী রামতারণবাবু। সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, বোসো মা, বোসো।
তাঁর সামনের শূন্য চেয়ারটিতে অর্চনা বসল। মা-ডাকটা হেডমিসট্রেসের কান এড়াল না।
ইন্টারভিউ হয়ে গেল। আর সকলের যতক্ষণ লেগেছিল তার অর্ধেক সময়ও লাগেনি। সংশয় যেখানে রেখাপাত করে না সেখানে যাচাই করবেন কতক্ষণ? সাধারণ দু-চারটে মাত্র প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেও শুধু রামতারণবাবুই করেছিলেন, আর কেউ না। দরখাস্তের উপর চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, এম. এ. পাস করেছ চার বছর আগে–এর মধ্যে আর কোথাও কাজ করেছ?
অর্চনা মাথা নেড়ে জানিয়েছে, কিছুই করেনি।
প্রশ্ন শুনে মনে মনে একটুখানি হিসেব করে নিয়েছিল নিখিলেশ। চার বছর আগে এম. এ. পাস করলে এখন কত হতে পারে?–ছাব্বিশ-সাতাশ। আর কারো দরখাস্ত চোখ চেয়ে দেখেনি। বয়েস দেখার জন্য এটাই বা কাকার কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে নেয় কি করে–! কিন্তু এই বয়সে ঠিক এ রকম কেন? ভাল করে দেখেও ঠাওর করতে পারেনি কি রকম।
রামতারণবাবু জিজ্ঞাসা করেছেন, এর আগে তাহলে ছেলেমেয়ে পড়াও নি কখনো?
না।
এরপর হেডমিসট্রেসের কথাটা মনে পড়েছিল রামতারণবাবুর। দরখাস্তের ওপর আর একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, তোমার যা কোয়ালিফিকেশন কলেজে চাকরি পাওয়া তত কঠিন নয়, ইস্কুলে আসতে চাও কেন?
ইস্কুল ভাল লাগবে মনে হয়েছে।
জবাবটুকুও ভাল লেগেছিল রামতারণবাবুর। দু-চার কথার পর তাকে বিদায় দিয়ে সকলের মনোভাব আঁচ করতে চেষ্টা করেছেন। তার পর প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করে ফেলেছেন একটা।– মেয়েটির লক্ষ্মীশ্রী আছে—
প্রফেসর বন্ধু হালকা হেসে শুধরে দিয়েছেন, সরস্বতী-শ্ৰী বলো–
রামতারণবাবু খুশীমুখে স্বীকার করে নিয়েছেন, তারপর সকলের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করেছেন, তাহলে–?
তাহলে যে কি, হেডমিসট্রেস অনুমান করেছেন। জবাব এড়িয়ে সমনোযোগে কথাগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলেন তিনি। জবাবটা এবার প্রফেসর বন্ধুর কাছ থেকেই আসার কথা। কিন্তু তিনিও বললেন না কিছু। অতএব রামতারণবাবুই নিজের মত ব্যক্ত করে ফেললেন, আমার তো মনে হয় এই মেয়েটাকে নেওয়া উচিত।
প্রফেসার বন্ধু সায় দিলেন, আমারও সেই রকমই মনে হয়।
মালতী রায় বললেন, উনি থাকেন যদি ওঁকেই সিলেক্ট করা উচিত শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবেন কিনা সেটাই কথা—
নিখিলেশ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে আবার। হেসে বলল, তাহলে আর ইন্টারভিউতে ডাকলেন কেন?
তেমনি হেসেই জবাব দিলেন মালতী রায়, আমি দরখাস্ত বাছাই করেছি–। বিবেচনার দায়িত্ব সকলের।
সুদক্ষা হেডমিসট্রেস হিসেবে তার জোর কম নয়। সেই জন্যেই সেক্রেটারির বিশেষ স্নেহের পাত্রীও তিনি। তাঁর খটকাটা একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারেন না রামতারণবাবু। কিন্তু কথাবার্তায় মার্জিত হলেও, বলার যা নিখিলেশ খোলাখুলিই বলে। বলল, থাকবে কি থাকবে না সে আর আপনাকে লিখে-পড়ে দিচ্ছে কে?
মালতী রায় সাফ জবাব দিলেন, যাঁকেই নেওয়া হোক, লেখাপড়া করেই নেওয়া উচিত এবার থেকে– সিজনের মাঝখানে ছেড়ে গেলে বড় অসুবিধে হয়।
বিসদৃশ শোনাবে জেনেও নিখিলেশ বলেই ফেলল, হলেও এই লেখাপড়ার কোন মানে নেই। আপনি যদি এখন স্কুল ছেড়ে কলেজে প্রিন্সিপাল হয়ে যেতে চান, লেখাপড়ার দায়ে আপনাকে আটকে রাখার কোন অর্থ হয়, না তাতে ফল ভাল হয়? সে-কথা যাক, কাকে নেওয়া হবে সেটাই ঠিক করুন।
মনে মনে রামতারণবাবু ভাইপোর ওপর ক্ষুণ্ণ হলেন একটু। আবার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর মতেও সায় দিতে পারলেন না। ফলে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে যে প্রস্তাব করে বসলেন সেটা আশা করেনি বোধহয় কেউ-ই। ছেড়ে গেলে অসুবিধে তো হয়ই, আবার দেখেশুনে বাছাই করে না নিলে পারা যায় কি করে।–তা এক কাজ করো তোমরা, তেমন কোয়ালিটির কাউকে না পেলে একই গ্রেড-এ আমরা হায়ার স্টার্টও দিতে পারি–একে তাই দাও, মাইনেটা গোড়া থেকেই ভাল হয়ে যাওয়ার কথা বললে যেতে না-ও পারে।
হেডমিসট্রেস কয়েক নিমেষ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে পরে হেসেই নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, আচ্ছা।
ওদিকে ইন্টারভিউ শেষ করে আবার টিচার্স-রুমেই ফিরে এলো অর্চনা বসু। যাবে কি করে, অঝোরে জল পড়ছে। গোটা আকাশটা মেঘে পুঞ্জীভূত।.স্টেশন কম করে পাঁচ মাইল। জলের দরুণ চট করে গাড়ি পাওয়াও সহজ নয়। আর এই জলে গাড়ি ডেকেই বা আনে কে।
ইন্টারভিউ-পর্ব শুরু হতেই টিচাররা বেশির ভাগ যে-যার সুবিধে মত ছুটছাট সরে পড়েছেন। কেউ গেছেন সাইকেল রিকশয়, কেউ বা আকাশের মতিগতির দিকে লক্ষ্য রেখে ছাতা ভরসা করেই বেরিয়ে পড়েছেন! পদ-প্রার্থিনীদের আত্মীয়-স্বজনরা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এসেছেন একে একে–কে কোন্ দিকে যাচ্ছেন জেনে নিয়ে কেউ কেউ তাঁদেরও সঙ্গ নিয়েছেন।