বর্ষাতি খোলার সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা সাদার মায়া ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কাচ-রঙা বর্ষাতির আড়ালে এই সাদারই আভাস পাচ্ছিলেন সকলে। সেটা সরে যেতেই সাদায়-সাদায় একাকার। খুঁটিয়ে দেখলে এই সাদার পরিপাটিতে আতিশয্যটুকু বড় হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু তার বদলে একটা অভিব্যক্তি বড় হয়ে উঠল।
হাত বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বর্ষাতিটা নিলেন কল্যাণীদি। দরজার আড়ালে ব্র্যাকেটে ঝুলিয়ে রাখলেন সেটা। হালকা আনন্দে সুশোভন কিছু বলেও বসতে পারতেন কল্যাণীদি। মহিলা সুরসিকা। চেনা-অচেনা সকলের সঙ্গেই সহজে জমিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু সহজ হওয়া গেল না, চেষ্টাও করলেন না। সাদরে ভিতরে এনে বসালেন শুধু।
আলাপ-সালাপ হল একটু-আধটু। আর পাঁচজনের সঙ্গে যেমন হয়েছে, প্রায় তেমনি। সেদিক থেকেও কোন ত্রুটি চোখে পড়েনি কারো। বরং ওই বেশবাসের মতই পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছে। তবু টিচাররা বেশ একটু ব্যবধান অনুভব করেছিল সেই প্রথম দিনেই। সেটুকুই আর ঘোচেনি। বরং বেড়েছে।
ইতিহাসের শিক্ষয়িত্রী নির্বাচনের ব্যাপারটা মোটামুটিভাবে যেন ওখান থেকেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই নির্বাচনে নীরবে অংশগ্রহণ করেছেন টিচার্স রুমের সকলেই। যাঁরা এসেছেন ইন্টারভিউ দিতে তাঁরাও। শিক্ষয়িত্রীরাও। শেষ পর্যন্ত ক-জন এলো না-এলো খোঁজ করতে এসেছিলেন হেডমিসট্রেস মালতী রায়। নাম লিখে নিতে এসেছিলেন। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দুই চোখও ওই একজনের মুখের ওপরে গিয়ে আটকেছিল। একে একে নাম লিখে নিয়েছেন তারপর। কিন্তু লেখার যেন আর দরকার বোধ করেননি খুব।
অনুমানে ভুল হয়নি। চাকরি অর্চনা বসুই পেয়েছে। চারজনের সিলেকশন কমিটি। সেক্রেটারি রামতারণবাবু, তাঁরই সমবয়সী অবসরপ্রাপ্ত এক প্রফেসার বন্ধু, ভাইপো নিখিলেশ–বাইরের এই তিনজন। ভিতর থেকে হেডমিসট্রেস মালতী রায়। ইন্টারভিউ-এর একরাশ দরখাস্ত যাচাই বাছাই করার দায়িত্ব ছিল হেডমিসট্রেসের ওপর। এই কর্তব্যপালনে সতোর কার্পণ্য করেননি– নিজের বান্ধবী পদপ্রার্থিনী, তা সত্ত্বেও না। কিন্তু নির্বাচনের আসরে বান্ধবীর জন্য পরোক্ষে যুঝতেও ছাড়েননি তিনি। যথার্থই সেটা বান্ধবীর জন্যে কি আর কোন কারণে সঠিক বলা শক্ত। অর্চনা বসুকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর প্রাধান্যে কোন ছায়া পড়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন কি না তিনি জানেন। যদি পড়েও থাকে, সেটা রূপেরও নয়, যোগ্যতারও নয়। টিচারদের মধ্যে রূপসী তাঁর থেকে প্রায় সকলেই। অন্যদিকে, তাঁর যোগ্যতা আর কর্মতৎপরতা বিবেচনা করেই স্কুল-কমিটি নিজ-খরচায় তাঁকে বাইরে থেকে ট্রেনিং দিয়ে এনে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর আসনে পাকাপোক্তভাবে বসিয়েছেন।
তবু একট হয়তো অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন হেডমিসট্রেস মালতী রায়।
সেক্রেটারি বা অন্য বৃদ্ধটির জন্যে তেমন ভাবেননি তিনি। তাঁর অমতে কিছু একটা করে বসতেন না তাঁরা। অন্তত তাঁর মতামতটা ভেবে-চিন্তে দেখতেন। কিন্তু বাধ সেধেছিল তৃতীয় লোকটি। লোকটি কেন, মালতী রায় মনে মনে ছোকরাই ভাবেন তাকে।–নিখিলেশ। সেক্রেটারির ভাইপো, যাঁর নামে এই স্কুল তার ছেলে। কল্যাণীদির বৈমাত্রেয় ভাই। কল্যাণীদির চেয়ে অনেক ছোট, বয়স তিরিশের নিচেই। এম. এস-সি পাস, সুদর্শন। বড়লোকের ছেলে হলেও উদ্যম আর কর্মঠ বলে পাঁচজনে সুখ্যাতি করে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিল বছর দুই, মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে এইখানেই কন্ট্রাক্টরি ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। এরই মধ্যে রোজগারও ভালই বলতে হবে। দিনের মধ্যে বহুবার নিজের ছোট একটা মার্কামারা হলদে গাড়িতে শহরময় চক্কর খেতে দেখা যায় তাকে। দু তিনটে বড় বড় ফ্যাক্টরিতে মাল সরবরাহ করে–এই কাজে মোটর হাঁকিয়ে কলকাতায় আসে সপ্তাহের মধ্যে কম করে চার দিন। স্থানীয় বাড়িঘরের কোন কাজ হলে ডাক পড়বেই তার। ইস্কুলের পুরনো দালানটাকেও ঢেলে নতুন করা হয়েছে তারই পরিকল্পনায় আর তত্ত্বাবধানে। নিজের যে-কাজেই ব্যস্ত থাকুক, বাবার নামের ইস্কুলটির যে-কোন প্রয়োজনে সে এক ডাকে হাজির।
এই নিখিলেশ দত্তও সিলেকশন কমিটির একজন। সে-ই বাদ সেধেছিল। সে-রকম আশঙ্কা অবশ্য মালতী রায় আগেই করেছিলেন। অর্চনা বসুকে টিচার্স-রুমে দেখার পরেই। কমিটির আলোচনায় তাকে নিয়ে যে সংশয়ের কথা তিনি বলেছিলেন, ছেলেটা এক কথায় সেটা নাকচ করে দিয়েছে। যেন সেটা কোন সমস্যাই নয়। অথচ অর্চনা বসুর ইন্টারভিউ-এর আগে পর্যন্ত তার হাবভাবে বেশ আশান্বিত হয়েছিলেন মালতী রায়। একে একে যে কজন ইন্টারভিউ দিয়ে গেল, তাদের সকলকেই প্রায় মোগ্য মনে করেছে নিখিল। হাবভাবে সেরকমই বুঝেছিলেন মালতী রায়। তার বান্ধবী ইন্টারভিউ দেবার পর তো নিয়োগের ব্যাপারটা একরকম সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই ভদ্রমহিলা এম. এ পাস, অন্য ইস্কুলে কিছুদিনের চাকরির অভিজ্ঞতাও আছে।
সব শেষে এসেছে অর্চনা বসু। সব শেষেই ডাকা হয়েছে তাকে।
ডাকতে পাঠিয়ে তার দরখাস্তটা সেক্রেটারির সামনে ঠেলে দিয়েছেন মালতী রায়। নিস্পৃহ মুখে বলেছেন, এঁর এমনি কোয়ালিফিকেশন হয়তো সব থেকে বেশি–কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই…তাছাড়া বেশি কোয়ালিফিকেশন হলে থাকেও না বড়।
সেক্রেটারির এ দুর্বলতা জানেন মালতী রায়। এটুকু সম্ভাবনার কাঁটা সেকালের মানুষটির চোখে অনেক গুণ নিষ্প্রভ করে দেবার মতই। যারা কাজ ছাড়ে, উন্নতির আশাতেই ছাড়ে। কিন্তু উন্নতি মানে কি? বিশ পঞ্চাশ এক শ টাকা বাড়তি? তারই জন্যে মেয়েগুলোর মায়া মমতা ছেড়ে হুট করে মাঝখানেই তাদের পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়ে চলে যেতে হবে? এ রকম মন নিয়ে ইস্কুলে পড়াতে আসা কেন? মেয়ে তৈরি করতে আসা কেন? গুণ যতই হোক, এই ত্রুটির দিকটা বরদাস্ত করতে রাজী নন সেক্রেটারি রামতারণবাবু।