গাইডকে জিজ্ঞাসা করল, এগুলো কি?
গাইড জানাল, যাদের ছেলে হয় না তারা ছেলের জন্য ফকিরের দোয়া চেঙে এই সুতো বা কাপড় বেঁধে রেখে যায়। কত দুর দূর দেশ থেকে নিঃসন্তান মেয়েরা সুতা বাঁধার জন্য এখানে আসে। কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি খ্রীস্টান, সবাই আসে। ছেলে কামনা করে এখানে এসে ভক্তিভরে সুতো বেঁধে দিলে ছেলে হবেই। ফকিরের আশীর্বাদ কখনো মিথ্যে হয় না–তিনশ বছর হয়ে গেল কিন্তু লোকের বিশ্বাস আজও যায় নি।
অর্চনার কানে আর এক বর্ণও ঢুকছে না। কি একটা সুপ্ত ব্যথা খচখচিয়ে উঠছে ভিতরে ভিতরে। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে সমস্ত মুখ। ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। ফকিরের সব কথা ননিমাধব শোনে নি। কিন্তু অর্চনার দিকে চেয়ে থমকে গেল সে।–কি হল?
জবাব না দিয়ে অর্চনা সুতো-বাঁধা সেই জালির দেয়ালের চারদিকে ঘুরতে লাগল। মুখে অব্যক্ত যাতনার চিহ্ন, চোখে নিষ্পলক, বিভ্রান্ত আকুতি। অজস্র সুতো বাঁধা-সুতোর পর সুতো। এই প্রত্যেকটা সুতো যেন এক একটা রক্ত-মাংসের কি হয়ে দেখা দিতে লাগল চোখের সামনে।
অজস্র, অগণিত তাজা শিশু!
কি এক অজ্ঞাত উত্তেজনায় অর্চনা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। আবারও কাছে এগিয়ে এল ননিমাধব। কি হল? খারাপ লাগছে কিছু?।
তার কথায় হঠাৎ যেন সচেতন হল অর্চনা। তাকাল। এপলকে ভেবে নিল কি। সমস্ত মুখ আরক্ত তখনো। বলল, না, গরম লাগছে, একটু জল পান কি না দেখুন তো…
হন্তদন্ত হয়ে জলের সন্ধানে ছুটল ননিমাধব। জলের তৃষ্ণা দু-চোখে এমন করে ফুটে উঠতে জীবনে আর দেখে নি কখনো।
ননিমাধব পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে অর্চনা একটা কাণ্ড করে বসল। ফ্যাশ করে দামী শাড়ির আঁচলটা ছিঁড়ে ফেলল। বৃদ্ধ গাইডের বিমুঢ় চোখের সামনেই সেই শাড়ির টুকরো জালির দেওয়ালে বেঁধে দিয়ে স্কুত সরে এল সেখান থেকে। সর্বাঙ্গে থরথর কাপুনি। দেহের সমস্ত রক্তই বুঝি মুখে উঠে এসেছে।
গাইড কয়েক নিমেষ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কি বুঝল সে-ই জানে। টেনে টেনে বলল ফকিরের দোয়া কখনো মিথ্যে হয় না মাইজী, শুচিমত থেকে। আর বিশ্বাস করে।
জল নিয়ে এসে ননিমাধব হতভম্ব। কারণ অর্চনা অন্যমনঙ্কের মত বলল, জলের দরকার নেই। দাদাবউদিও এসেছিল, ওর মুখের দিকে চেয়ে অবাক তারাও। বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল কি হয়েছে।
অর্চনা কথা বলতে পারছে না। নিজেকে আড়াল করতে পারছে না বলেই বিব্রত হয়ে পড়ছে আরো বেশি। ছেঁড়া শাড়ির আঁচল ঢেকে ফেলেছে, তবু অস্ফুটস্বরে শুধু বলল, শরীর ভাল লাগছে না, এক্ষুনি ফেরা দরকার।
দ্রুত সিঁড়ির দিকে এগোল সে। ব্যাকুল, উদগ্রীব। একটা মুহূর্তও হাতে নেই যেন আর। তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে লাগল।
সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি। মাগো! এ-সিঁড়ির কি শেষ নেই?
তাড়াহুড়ো করে সকলে হোটলে ফিরল আবার। কিন্তু কি ব্যাপার ঘটে গেল হঠাৎ ভেবে না পেয়ে সকলেই বিভ্রান্ত একেবারে। দাদা-বউদি ননিমাধবকেই এটা-সেটা জিজ্ঞাসা করতে লাগল। কিন্তু সে-ও বিমূঢ় কম নয়।
অর্চনা ঘোষণা করল সেই রাতের ট্রেনেই কলকাতা ফিরবে। আবারও আকাশ থেকে পড়ল সকলে। কিন্তু তার দিকে চেয়ে মুখে আর কথা সরে না কারো। স্থানীয় ডাক্তার ডেকে ব্লাড প্রেসার দেখিয়ে নেওয়ার কথাও মনে হয়েছে সকলেরই। কিন্তু শোনামাত্র অর্চনা রেগে উঠল এমন যে সকলে নির্বাক।
ট্রেনে সারা পথ এক অধীর প্রতীক্ষায় নিঃশব্দে ছটফট করতে দেখা গেল তাকে। বেশি রাতে অন্য দুজন যখন তন্দ্রাচ্ছন, ননিমাধব কাছে এল। সত্যিকারের আকৃতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে বলবে না?
অর্চনা সচকিত হয়ে তাকাল। কিছু একটা ভাবনায় ছেদ পড়ল। ও-টুকু মেহের স্পর্শেই দু-চোখ ছলছল করে এল। অস্ফুট জবাব দিল, কি বলব।
এভাবে চলে এলে কেন?
তেমনি মৃদুকণ্ঠে অর্চনা বলল, আসা দরকার যে … আবারও তাকাল। হঠাৎ এই মানুষটির জন্যেও বুকের ভিতরটা ব্যথায় টনটনিয়ে উঠল। একটা উদগত অনুভূতি ভিতরে ঠেলে দিয়েই অস্ফুট স্বরে বলল, একটা কথা রাখবেন?
উদ্গ্রীব প্রতীক্ষায় ননিমাধব আরো একটু কাছে এগিয়ে এলো শুধু।
আমাকে ভুলে যান। নইলে এত অপরাধের বোক আমি বইব কেমন করে!
জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে মুখ ফেরাল সে। বিস্ময়ে বেদনায় ননিমাধব বোবা একেবারে।
কলকাতা।
হঠাৎ এভাবে ফিরতে দেখে মিসেস বাসু পাঁচ কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। বিজন বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, জিজ্ঞেস করে দেখ তোমার মেয়েকে, আমরা কিছু জানি না।
মেয়েকে দুই এক কথা জিজ্ঞাসা করে ডক্টর বাসুও কিছু হদিস পেলেন না। ধীরে-সুস্থে জানা যাবে ভেবে আর উত্ত্যক্ত করতে চাইলেন না।
দুপুরের দিকে বিজন বেরিয়েছে। বউদি রাতের ক্লান্তি দূর করছে।
অর্চনা চুপচাপ বেরিয়ে পড়ল।
ট্রাম থেকে নেমে একটুখানি হাঁটা-পথ, তার পর বাড়ি। অৰ্চনা সমস্ত বাড়িটাকে একবার দেখে নিল।
দরজা বন্ধ। বন্ধই থাকে।
কড়া নাড়ল। একবার, দুবার—
সাড়া নেই।
আরো জোরে কড়া নাড়ল। মনে মনে হিসেব করছে, যতদূর মনে পড়ে এ দিনটা অফ-ডে। নাকি রুটিন বদলেছে কলেজের। কিন্তু তাহলে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ কেন, বাইরে তালা ঝোলার কথা। অবশ্য, সাবি থাকতে পারে
ও-দিক থেকে দরজা খোলার শব্দ।
শরীরের সমস্ত রক্ত আবার মুখে এসে জমেছে অর্চনার।
দরজা খুলল। অর্চনা স্তব্ধ।