সকাল থেকে এক ফোঁটা আকাশ দেখা যায়নি। কালি বর্ণ মেঘ গোটা দিন বর্ষানোর পরেও পাতলা হয়নি। দুপুর থেকেই খেয়া পারাপার বন্ধ ছিল। ওপার থেকে এপারে আসতে হলে ট্রেনে ব্রীজ পার হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
সকলেই ভেবেছিলেন ইন্টারভিউ আর সে-দিন হল না। যাঁদের ডাকা হয়েছে তাঁরা আসবেন কেমন করে? তবে স্থানীয় বা আশপাশ থেকে যে দু-তিনজনকে ডাকা হয়েছে তাঁরা আসতে পারেন। হেডমিসট্রেস অবশ্য কমিটিকে, অন্যথায় সেক্রেটারিকে টেলিফোনে জানিয়েছেন ইন্টারভিউ হবে। কারণ, এই দুর্যোগ মাথায় করেও যাঁরা আসবেন তাঁদের ফেরাবেন কি বলে?
তাঁর আগ্রহের কারণও ছিল একটু। পদ-প্রার্থিনীদের মধ্যে তাঁর এক বান্ধবী আছেন। তিনি এসেই আছেন, এবং যথাসময়ে হাজিরও দেবেন। জলের দরুণ মনে মনে তেমনি খুশী হয়েছিলেন বিজ্ঞানের টিচার শোভা ধর। ইন্টারভিউ দেবার জন্য তাঁরও এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়া তাঁর বাড়িতেই এসে উঠেছেন। যথাসময়ে তিনিও আসছেন।
কোন ক্লাসেই সেদিন দু-তিনটির বেশি মেয়ে আসেনি। ছাতা সত্ত্বেও তারা ভিজে চুপসে এসেছে আর এসেই টিচারদের কাছে কড়া ধমক খেয়ে সেই অবস্থাতেই বাড়ি ফিরে গেছে। নিশ্চিন্ত মনে এবং প্রসন্ন চিত্তে টিচাররা নিজেদের ঘরে বসে জল দেখছিলেন আর জটলা করছিলেন।
কর্মপ্রার্থিনীদের আবির্ভাব ঘটতে লাগল একে একে।
সাতজনের মধ্যে পাঁচজন এসে গেলেন। হেডমিসট্রেস আর শোভা ধর দেখলেন তাঁদের বান্ধবী বা আত্মীয়ার মত চালাক প্রায় সকলেই। আগে থাকতেই যে-যার আত্মীয়-পরিজনের কাছে এসে উঠেছিলেন নিশ্চয়। টিচারদের ঘরেই তাঁদের বসার ব্যবস্থা। টুকরো টুকরো আলাপ পরিচয় চলল। কে কোথা থেকে আসছেন, কোথাও কাজ করছেন কি না, ইত্যাদি। শিক্ষয়িত্রীদের সহজতায় পদপ্রার্থিনীদের সঙ্কোচ বাড়ছে বই কমছে না।
সেক্রেটারি রামতারণবাবু হেডমিসট্রেসের টেলিফোন পেলেন আবার। সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই এসে গেছেন। অতএব যেতে হয়। বুড়ো মানুষ, চাদরমুড়ি দিয়ে আয়েশ করে গড়গড়া টানছিলেন আর বৃষ্টিঝরা আকাশ দেখছিলেন। কিন্তু গড়গড়া ছেড়ে এ দুর্যোগে আবার বেরুতে হবে বলে বিরক্তি নেই একটুও। বরং হেডমিসট্রেসের টেলিফোন পেয়ে খুশী।…ভবতারণ গার্লস স্কুলের চাকরি, ঝড়জল মাথায় করেও আসবে বই কি সব ইন্টারভিউ দিতে। পাঁচজন এসেছে, গিয়ে হয়তো শুনবেন আর দুজনও এসে গেছে।
চাকরকে ডেকে তিনি গাড়ি বের করতে বললেন।
খুশী হওয়ার কারণ আছে রামতারণবাবুর। এই ছোটখাটো উপলক্ষ থেকেই ইস্কুলের কদর বোঝা যায়। বাছাই করা কোনো টিচার উন্নতির বা ভবিষ্যতের আশায় অন্যত্র চলে গেলে বিলক্ষণ রেগে যান তিনি। তবু বছরে দু-বছরে এ রকম এক-আধজন তো যায়ই। এবারেও ইতিহাসের শিক্ষয়িত্রীটি কলেজে চাকরি পেয়ে চলে গেছেন বলেই নতুন শিক্ষয়িত্রী নিতে হচ্ছে। কিন্তু এই ইস্কুলে যোগ্য শিক্ষয়িত্রীর অভাব হয় না তা বলে। বরং একজন গেছে বা যাচ্ছে শুনলে বাড়িতে সুপারিশের হিড়িক পড়ে যায়।
গোটা শহরে একটাই মেয়ে-ইস্কুল। সমস্ত জেলায় নামডাক। মেয়েদের একটা হোস্টেল করে দিলে বাইরে থেকেও কত মেয়ে পড়তে আসত ঠিক নেই। এ-জন্যেও অনেক আবেদন নিবেদন এসেছে সেক্রেটারির কাছে। কিন্তু এমনিতেই ইস্কুল ভর-ভর্তি, বছরের গোড়ায় ভর্তি হতে এসে ফিরে যায় অর্ধেক মেয়ে– হোস্টেল খুলবেন কি। ইস্কুলের এত সুনাম শুধু শিক্ষকতা বা বাৎসরিক ফলাফলের দরুনই নয়। সরকারের থেকে এক পয়সা সাহায্য না নিয়েও সরকারী ইস্কুলের দেড়গুণ মাইনে আর কোন ইস্কুলের টিচার পায়? কাগজে একটি শিক্ষয়িত্রী-পদের বিজ্ঞাপনের জবাবে দরখাস্ত এসেছিল দেড়-শ। ডাকা হয়েছে সাতজনকে। নেওয়া হবে একজন।
রামতারণবাবু একেবারে মিথ্যে অনুমান করেননি। তিনি এসে পৌঁছুবার আগে সাতজন পদপ্রার্থিনীর বাকি দুজন না হোক, আর একজন এসেছিল।
অর্চনা বসু এসেছিল।
তিন দাগ কাটা একটা ঝরঝরে ঘোড়ার গাড়ি বাগান পেরিয়ে টিচার্স-রুমের একেবারে সামনে এসে দাঁড়াতে সকলেই বুঝেছিলেন ঝড়-বাদলা উপেক্ষা করে আর একজন এলো ইন্টারভিউ দিতে। যে পাঁচজন এসে আছেন তাঁদের সকলকেই যে যাঁর মত ওজন করে নিয়েছেন শিক্ষয়িত্রীরা। নতুন কৌতূহলে ঘোড়ার গাড়ির দিকে চোখ ফেরালেন তাঁরা।
অর্চনা বসু নামল। গায়ে কাচ-রঙের হালকা লেডিস বর্ষাতি। ভিজে সপসপ করছে। মাথা-ঢাকা সত্ত্বেও জলের ঝাপটা থেকে মুখ বা সামনের চুলের গোছ বাঁচেনি। ভাড়া মিটিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো হলঘরের দিকে।
হল-জোড়া বড় টেবিলের সামনের দিকে বসেন কল্যাণীদি। ছাত্রী শিক্ষয়িত্রী সকলেরই দিদি। এমন কি হেডমিসট্রেসেরও। বয়সের দরুন নয়, বয়স বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশের এধারেই হবে। রামতারণবাবুর ভাই-ঝি তিনি, ভবতারণ মিত্রের মেয়ে–যাঁর নামে এই ইস্কুল। তাড়াতাড়ি উঠে এসে তিনি অভ্যর্থনা জানালেন।
আর যাঁরা ইন্টারভিউ-এর জন্য এসেছেন তাঁদের চোখে পড়ল সেটুকু। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কেউ কিনা অনুমান করতে চেষ্টা করলেন। অন্যান্য টিচাররা জানেন, তা নয়। কিন্তু নীরব আগ্রহে ঘাড় ফিরিয়েছেন তাঁরাও।
ঘরে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল অর্চনা বসু। বর্ষাতিটা বেজায় ভেজা গা থেকে খুলে ফেলল ওটা, কোথায় রাখা যায় ঠিক বুঝতে না পেরে ঈষৎ কুণ্ঠায় কল্যাণীদির দিকে তাকাল।