দিল্লী-পর্ব সেরে আগ্ৰায় আসার মধ্যেই ননিমাধব মনে মনে অনেকটা ভরসা পেয়েছে। তার থেকেও বেশি ভরসা পেয়েছে–বউদি। আগ্রায় এসে ইতিহাসের আয় ছাড়াও অন্য দু-চারটে কথা বলতে শুরু করেছে ননিমাধব। যেমন, বেড়াতে কেমন লাগছে, আজকাল কথা এত কম বলে কেন অর্চনা, ইত্যাদি।
তাতেও বিরূপ বা বিরক্ত হতে দেখা যায় নি অর্চনাকে। চতুর্থবার তাজমহল দেখতে দেখতে ননিমাধবের কথা শুনে তো বেশ জোরেই হেসে ফেলেছিল। ননিমাধব একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, তাজমহল যে প্রেমের স্মৃতি-সমাধি, এখানে আসার আগে এমন করে কখনো মনে হয় নি–শাজাহানের দীর্ঘনিঃশ্বাস গুলোই যেন জমে পাথর হয়ে আছে।
অর্চনাকে হঠাৎ অমন হেসে উঠতে দেখে ননিমাধব অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল। লজ্জায় ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। দাদা বউদি উৎফুল্ল মুখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসেছে। অর্চনা হেসেই বলেছে, কেন তোমরা রোজ রোজ এই তাজমহলে আস বল তো…ভদ্রলোকের মন খারাপ হয়ে যায়।
এতদিনে বিজন মনে মনে সত্যিই পার্টনারের তারিফ করল। খুশীর কানাকানি চলতে লাগল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। একটা গুরু বোঝা হালকা হল।
পরদিনের প্রোগ্রাম ফতেপুর সিক্রি।
মাইল পঁচিশ দূর আগ্রা থেকে। মোটরে চলেছে সকলে। দূর থেকে ইতিহাসের স্মৃতি-সমারোহের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। অর্চনার দিকে চেয়ে ননিমাধব নীরব কৌতূহলের আভাস পেল।
মোটর থেকে নামতেই তিন-চারজন গাইড ছেকে ধরল তাদের। এই ব্যাপারটা দিল্লীতেও দেখেছে, আগ্রাতেও দেখেছে। অদূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল একজন অতিবৃদ্ধ গাইড। শনের মত সাদা চুল, সাদা দাড়ি। পরনে সাদা মলিন ঢোলা আলখাল্লা। জোয়ানদের সঙ্গে ঠিকমত পাল্লা দিতে পারে না বলেই হয়তো সবিনয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। যদি কেউ নিজে থেকেই ডেকে নেয়।
ডেকে নিল। কে জানে কেন তাকেই পছন্দ হল ননিমাধবের। বুড়ো মানুষ, দেখাবে-শোনাবে ভাল।
সামনেই আকাশ-ছোঁয়া সিঁড়ির সমারোহ। বিশাল, বিস্তৃত সিঁড়ি। প্রতিটি সোপান মর্ত্যের মানুষের কালোত্তীর্ণ আকাক্ষার স্বাক্ষর। সকলে উঠতে লাগল। অনেক দূর থেকে কোন মুসলমান পীরের যান্ত্রিক সুরের স্তোত্ৰ-গান ভেসে আসছে। অদ্ভুত যুক্ত পরিবেশ। কাল যেন এক অপরিমেয় স্মৃতিভার বুকে করে এইখানটিতে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে।
সিঁড়ির শেষে বিশাল চত্বর। গাইড ঘুরতে লাগল তাদের নিয়ে। গল্প করতে লাগল। ইতিহাসের গল্প। এটা কেন, ওটা কি ইত্যাদি। চোস্তু উদ্ৰ অনেক কথাই বোঝা গেল না। কেউ চেষ্টাও করল না বুঝতে। গাইড আপন মনে তার কাজ করে যাচ্ছে, অর্থাৎ বকে যাচ্ছে–এরা নিজেদের মনে কথাবার্তা কইতে কইতে দেখেছে। শুধু অর্চনারই দু-চোখ ইতিহাস-স্মৃতি-প্রাচুর্যের মধ্যে একেবারে হারিয়ে গেছে।
ঘুরতে ঘুরতে এক সময়ে শ্রান্ত হয়ে পড়েছে সকলে। শেষ নেই যেন। রাণুদেবী এক জায়গায় বসে পড়ল, তোমরা ঘোরর বাবা, আমি আর পারিনে
জলের ফ্লাস্কের জন্য হাত বাড়াল সে। ফ্লাস্ক বিজনের কাঁধে। অতএব বিজনও বিশ্রামের সুযোগ পেল একটু। ওদিকে গাইডের পাশে অর্চনা, কাজেই তার পাশে ননিমাধব। তারা এগিয়ে চলল আবার। ওই দুজনের বসে-পড়াটা মিষ্টি কিছু ইঙ্গিত মনে করে শ্রান্তি সত্ত্বেও ননিমাধব তুষ্ট এবং উৎফুল্ল। কিছু একটা বলার জন্যেই এক সময় মন্তব্য করল, কি উদ্ভট শখ ছিল আকবর লোকটার, এ-রকম একটা ছন্নছাড়া জায়গায় এসে এই কাণ্ড করেছে বসে বসে!
গাইড তার কথাগুলি সঠিক না বুঝুক, বক্তব্য বুঝল। গল্পের খোরাক পেল আবার।–শখ নয় বাবুজি, শাহান-শা বাদশা এখানে ফকির চিশতির দোয়া মেঙে সব পেয়েছিলেন বলেই এখানে এই সব হয়েছিল।
গাইড বলতে লাগল, এই তামাম জায়গা তো জঙ্গল ছিল, কেউ আসত না, শের আর বুনো হাতী চরত। শাহান-শা আকবর যুদ্ধফেরত এখানে এক রাতের জন্য আটকে পড়েছিলেন। এই ভীষণ জঙ্গলের গুহায় সাধন-ভজন করতেন এক পয়গম্বর পুরুষ–ফকির সেলিম চিশতি।…
কথা শুনতে শুনতে এগোচ্ছিল ওরা। খুব যে আকৃষ্ট হয়েছিল এমনও নয়। ননিমাধব তো নয়ই। অর্চনার মন্দ লাগছিল না অবশ্য। গাইড গল্প বলে চলেছে, এতবড় বাদশা সেই ফকিরকে দেখামাত্র কেমন যেন হয়ে গেলেন!
…তাঁর দোয়া মাঙলের বাদশা।
শাহান শার মনে ছিল বেজায় দুঃখু। খাস বেগমের দু-দুটো ছেলে হয়ে মরে গেছে, আর ছেলে হয় নি। তখৎ-এ-তাউসে বসবে কে? কাকে দিয়ে যাবেন মসনদ।
ফকির চিশতি বললেন, আল্লার দোয়ায় বাদশার আবার ছেলে হবে। বেগমকে এইখানেই নিয়ে আসতে বললেন সেলিম চিশতি। আকবর বাদশা তাই করলেন। ন-মাস ছিলেন এখানে বাস বেগমকে নিয়ে। তার পর ছেলে হল। ছেলের মত ছেলে। বাদশা জাহাঙ্গীর। শাহান-শা গুরুর নামে ছেলের নাম রাখলেন সেলিম। আর ফকিরগুরুর আশ্রমে বাস করবেন বলে সব জাল সাফ করে এখানে এত বড় রাজদরবার গড়ে তুললেন তিনি। ফকির বই বাদশা আকবর আর কিছু জানতেন না।
কখন যে নিবিড় আগ্রহে শুনতে শুরু করেছে অর্চনা নিজেই খেয়াল নেই। হঠাৎ কেন এমন করে স্পর্শ করল এই কাহিনী তাও জানে না। শুনতে শুনতে একটি সমাধির কাছে এসে দাঁড়াল তারা। মার্বেল পাথরের অভ্র সমাধি লাল কাপড়ে জড়ানো চারিদিকে নক্সাকাটা পাথরের জালি দেয়াল।
গাইড জানাল, এই ফকির চিশতির সমাধি।
অর্চনা কেমন যেন অভিভূত। দেখছে চুপচাপ। আর কি-একটা অজ্ঞাত আলোড়ন হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, সেই জালির দেয়ালে অসংখ্য সুতো আর কাপড়ের টুকরো বাঁধা। সুতোয় আর কাপড়ের টুকরোয় সমস্ত দেয়ালটাই বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে।