মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অদূরের রেলিঙের কাছে স্তব্ধ মূর্তির মত আরো কেউ দাঁড়িয়ে, চোখে পড়ল না। নিজের ঘরে এসে শষ্যায় মুখ ঢাকল সে।
পায়ে পায়ে রেলিং ছেড়ে ওর দোয়গোড়ায় এসে দাঁড়ালেন ডক্টর বাসু। দেখলেন। ভিতরে এসে বিছানার এক পাশে বসলেন। তার পর আস্তে আস্তে একখানা হাত রাখলেন মেয়ের পিঠের ওপর।
অর্চনা মুখ তুলল। গাল বেয়ে অঝোরে ধারা নেমেছে। নিঃশব্দ দৃষ্টি বিনিময়। দুই হাতে তাকে আঁকড়ে ধরে অর্চনা ছোট মেয়ের মত বাবার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজল এবার।
ডক্টর বাসু গভীর মমতায় মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
দু-চোখ তাঁরও চিক চিক করছে।
.
দিন যায়। বছর ঘুরে আসে আরো একটা।
মা বলতে গেলে একরকম তফাতেই সরে আছেন। আর কারো কোন ভাল-মন্দে নেই যেন তিনি। দাদাও চুপচাপ, নির্লিপ্ত। শুধু বাবার ঘরেই আগের মত ডাক পড়ে অৰ্চনার। আগের মত নয়, আগের থেকেও বেশি। আলোচনার ঝোঁকে এক-একদিন সব দুর্ভাবনা সত্যিই ভোলেন তিনি।
কিন্তু অর্চনা ভিতরে ভিতরে হাঁপিয়েই উঠছে। বিষয়ারে প্রাইভেটে এম. এ. পরীক্ষা দেবে আবার, ঠিক করেও পড়াশুনা বলতে গেলে এগোর নি। এক একসময়ে ভাবে, চাকরি-বাকরি নিয়ে কোথাও চলে যাবে। এম. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার দরুন চাকরি সহজেই জুটতে পারে। কিন্তু তাতেও উৎসাহ নেই খুব। তার ওপর কোথাও দরখাস্ত করেছে দেখলে বাবাই প্রকারান্তরে বাধা দেন বলেন, করবি’খন চাকরি, এত তাড়া কিসের, চাকরি না করলেও তোর কোন ভাবনা নেই।
নেই বলেই এমন ক্লান্তিকর শূন্যতা। কোন কিছুর জন্যেই আর ভাবনা নেই তার। সব ভাবনা চুকিয়ে বসে আছে। এমন ভাবনাশুন্যতার মধ্যে নিজের অস্তিত্বটাই দুর্বহ বোঝার মত মনে হয়। বাড়িতেও আর অশান্তির কারণ নেই। কিছু, গৃহকর্তার নিষেধ আছে কেউ যেন ওকে উত্ত্যক্ত না করে। কাদার সামনে মায়ের মুখের ওপর সেই মর্মান্তিক আলা প্রকাশ করে ফেলে অর্চনা নিজেই অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে। মনে মনে অনুতপ্ত হয়েছে।…নিজেরই ভাগ্য, দোষ কাকে দেবে।
একটানা অবকাশে আর একজনের কথাও মাঝে মাঝে ভাবে। জীবনের সঙ্গী হিসেবে যাকে কখনো কল্পনাও করতে পারে নি, সেই একজনের কথা। ননিমাধব–। এখনো আসে। দাদা আর মায়ের মুখ চেয়েই বুঝতে পারে বোধহয় একটু কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। তবু আসে…তার এই নীরব প্রতীক্ষা যাতনার মত বেঁধে। ইচ্ছে করলেই ভাল বিয়ে করতে পারে, সুখী হতে পারে। কিন্তু সেটা তাকে বুঝিয়ে বলে কে। অর্চনা ভাবে, সম্ভব হলে ও নিজেই একদিন বলবে। ননিমাধব এলে ওকে আর ভাকাডাকি করে ঘরে আনতে হয় না। নিজে থেকেই এসে বসে এক-একদিন। দু-পাঁচটা সাধারণ কথাও বলতে চেষ্টা করে, চা করে দেয়।
কিন্তু ওইটুকুই যে-ভাবে নাড়া দেয় ভদ্রলোককে দেখে সব সময় আবার সামনে যেতেও ইচ্ছে করে না। তার চোখে-মুখে প্রত্যাশার আলো দেখে থমকে যায়। অর্চনা দিকতকের মত নিজেকে গুটিয়ে ফেলে আবার।
কি-ই বা করতে পারে এছাড়া। ওর জীবন-বাস্তবে, যৌবন-বাস্তবে ঘর মতই আবির্ভাব যার তার আনন্দ বিষাদ হিংসা ক্রোধ সবই পুরুষের। সেই পুরুষ ছিনিয়ে নিতে জানে। নিয়েছেও। ওখানেই নিঃশেষে সর্বসমর্পণ ওর বিধিলিপি। …আজও সেটুকু গোপন স্মৃতির মতই। ও-যে কিছুই আর হাতে রেখে বসে নেই। এই রিক্ততা নিয়ে নতুন করে আবার একজনের সঙ্গে আপস হবে কেমন করে।
এক বছরে মানুষ অতি বড় বিপর্যয়ও তোলে, মায়ের আর দাদার রাগ বা অভিমান ভোলাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাছাড়া অর্চনার শান্ত পরিবর্তনটুকুও হয়তো কিছুটা আশার কারণ তাদের। বউদি আয় মায়েতে মিলে গোপনে গোপনে আবার বেন কি পরামর্শ শুরু হয়েছে একটা।
অর্চনা হঠাৎ শুনল, কিছুদিনের জন্যে বাইরে বেড়াতে বেরুনো হবে। দাদা জানাল, অর্চনার জন্যেই বিশেষ করে চেঞ্জে ঘুরে আসা দরকার, দিনকে দিন তার শরীর খারাপ হয়ে পড়ছে। তাছাড়া একঘেয়ে ব্যবসায়ের ঝামেলায় ক্লান্ত নাকি নিজেরাও। নিজেরা বলতে আর কে অর্চনা বুঝে নিল। দাদার মুখের ওপর আপত্তি করতে পারল না। এমনিতেও বাদ-প্রতিবাদ আর কারো সঙ্গেই করে না বড়। তাছাড়া ভিতরে ভিতরে সত্যিই এমন ক্লান্ত যে কোথাও বেরুনোর প্রস্তাবটা নিজেরই খারাপ লাগল না। তার ওপর বাবাও ওকে ডেকে বললেন, তোর শরীর সত্যিই ভাল দেখছি না, ওদের সঙ্গে–দিনকতক ঘুরে-টুরে এলে ভালই লাগবে।
সত্যিই বেরিয়ে পড়া হল একদিন। অর্চনার ইচ্ছে ছিল বরুণাও সঙ্গে থাক। কিন্তু তার নাকি শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটি মিলল না। আসলে বরুণ নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে এবং দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে সরে রইল। চারজনে বেরিয়েছে। সদা বউদি ননিমাধব আর অর্চনা। দিল্লীতে দিনকতক থেকে যাওয়া হবে আগ্রায়। আগ্রায় আবার দিনকতক থাকা, তারপর প্রত্যাবর্তন।
একেবারে কাছাকাছি থাকার দরুন এবারে কিছুটা সহজ হল ননিমাধব। তার রুমালে করে মুখ মোছা কমতে লাগল। দলের দুজন যে তার দিকে সে তো জানেই, এই বেড়ানোর তাৎপর্যও জানে। সুযোগ-সুবিধে মত অর্চনার সঙ্গে কথাবার্তা বলার অবকাশ অন্য দুজনেই করে দেয়।
অর্চনাও সদয় ব্যবহারই করছে তার সঙ্গে। হেসে কথা বলে কথা শোনে। সে ইতিহাসের ছাত্রী। ইতিহাস স্মৃতি বা ইতিহাস-নিদর্শনের প্রতি ননিমাধবের সদ্ধ জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরে হেসেই জবাব দেয় যেটুকু জানে। অন্য দুজনের শোনার থেকেও দেখার দিকেই ঝোঁক বেশি। কাজেই দেখার সমারোহের মধ্যে দেখতে দেখতে এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে পড়বে তার, সে আর বিচিত্র কি।