অর্চনা হাত ধরে বসিয়েই রাখল তাকে উঠতে ছিল না। চুপচাপ দুজনেই। দুজনেরই চোখ ছলছল।
এর পর যত দিন যায়, অর্চনার বিয়ের চিন্তায় মনে মনে উদগ্ৰীব সকলে। এ. এ. পাশ করার পর ননিমাধবের হাজিরাও নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মায়ের গরজ বালাই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিবাহ-প্রসঙ্গটা তিনি এখন উত্থাপন করলেন মেয়ের কাছে। করে, ধমক খেলেন। তার পর মায়ের তাড়নায় ভয়ে ভয়ে হাল ধরতে এলো বরুণ। এসে সে-ও ধমক খেল। সব শেষে বউদি। রঙ্গরস করে তিনি অগ্রসর হলেন, বলি ব্যাপারখানা কি?
বসে কি একটা পড়ছিল অর্চনা। মুখ তুলে তাকাল।
রোজ রোজ ভদ্রলোক এসে বসে থাকেন, দেখে মায়াও হয় না একটু?
অর্চনা তেমনি চেয়ে আছে। একটু বাদে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, কি করতে বলো?
অস্বস্তি চেপে বউদি একটু জোর দিয়েই বলল, বিয়েটা করে ফেললেই তো চুকে যায়।
ভিতরে ভিতরে তেতে উঠলেও সেটুকু প্রকাশ পেল না। বিয়ে করব কোনদিন তোমাদের বলেছি?
বলছ না বলেই তো ভাবনা–
তোমরা এই ভাবনা-টাবনাগুলো বাদ দিয়ে চললে আমার এখানে থাকাটা একটু সহজ হয় বউদি।
গম্ভীর মুখে আবার বই টেনে নিল সে। বউদি পালিয়ে বাঁচল।
বই রেখে অর্চনা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। পড়াশুনো নিয়ে ছিল ভাল। এই ঢালা অবকাশ দুর্বহ। স্মৃতিপথে যারা ভিড় করে আসে দু-হাতে তাদের ঠেলে সরিয়ে রাখার চেষ্টায় ভিতরে ভিতরে ক্লান্ত সে। প্রতিটি দণ্ড পল মুহূর্ত ভারি বোঝার মত।
রাস্তায় দুটো মেয়ে পুরুষ গান গেয়ে ভিক্ষা করছে। পুরুষের গলায় সস্তা একটা হারমোনিয়াম বোলানো, মেয়েটির কাঁধের দুদিকে দু-পা ঝুলিয়ে বসে একটা কচি বাচ্চা। হালকা গান। এই দুনিয়ায় নারী-পুরুষের অনাবিল বিনিময় গানের বিষয়বস্তু। অনেকে শুনছে, কেউ কেউ পয়সা দিচ্ছে। অর্চনা নির্নিমেষে দেখছে। জীবন-ধারণের একটা যৌথ প্রচেষ্টা দেখছে। মেয়েটার কাঁধের শিশুটিকে দেখছে।
অর্চনার সর্বাঙ্গে কিসের শিহরণ। চেষ্টা করেও পারছে না অন্যমনস্ক হতে। ঝাপসা চোখের সামনে একটা অয়েল-পেন্টিং ছবি এসে পড়ছে বার বার। সেই ছবিতে নারীর আকুতি। অব্যক্ত নীরবতায় সেই নারী যেন ওই প্রতীক্ষা করে ছিল, ওর কাছেই কিছু চেয়েছিল। সেই চাওয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বসে ছিল আর একটি বৃদ্ধা বিধবা।…আর তারা চাইবে না। তাদের চাওয়া শেষ।
অর্চনা জানালা থেকে সরে এলো। ভিতরটা ধড়ফড় করছে কেমন।
অব্যক্ত যাতনায় মন থেকে সবকিছু আবার বেড়ে ফেলতে চেষ্টা করল সে। আবার পড়বে। হোক একটা বিষয় নিয়ে আবারও পড়ায়ে শুরু করবে।
সঙ্কল্পটা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোকের ভি ভাবনা। বিশেষ করে মায়ের আর বিজনের। এখনই একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। পড়াশুনায় এগিয়ে গেলে আবারও দু বছরের ধাক্কা। এম. এ পাস করেছে তার সাত-আট মাস হয়ে গেল।
অর্চনা জানে, ননিমাধবের সঙ্গে তার বিয়েটা সম্পন্ন করার পিছনে দাদারই আগ্রহ আপাতত সব থেকে বেশি। শুধু বন্ধু নয়, এতবড় এক উঠতি ব্যবসায়ের অর্ধেক অংশীদার। তাকে আত্মীয়তার মধ্যে এনে ফেলতে পারলে ষোল-আনা নিশ্চিন্ত।
রাত্রিতে সেদিন দাদার ঘরে ডাক পড়তে অর্চনা এসে দেখে, ঘরে শুধু মা আর দাদা বসে। সঙ্গে সঙ্গে কেন ডাকা হয়েছে অনুমান করতে দেরি হল না।
বিজন মোলায়েম করে বলল, বোস, কি করছিলি?
কিছু না।…বিছানার একধারে মা বসে, অন্য ধারে সে-ও বসল।
বিজন জিজ্ঞাসা করল, তুই আবার কি নিয়ে পড়াশুনো আরম্ভ করছিস শুনলাম?
অর্চনা জবাব দিল না। দোরগোড়ায় ডক্টর বাসু এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর দিকেই চোখ গেল সকলের। একবার দেখে নিয়ে তিনি দরজার কাছ থেকে সরে গেলেন। বিজন ভণিতা বাদ দিয়ে সোজা আসল বক্তব্য উত্থাপন করল। এম. এ. পাস তো হয়েই গেছে, আবার পড়াশুনো কিসের–তাছাড়া, তুই এভাবে থাকবি কেন, আমি তো কিছু বুঝি না।
অর্চনা দাদার চোখে চোখ রাখল।–তোমার কি ইচ্ছে?
মিসেস বাসু নীরবে ছেলের দিকে তাকালেন। বিজন আমতা-আমতা করে বলল, আমার ইচ্ছে, আমার কেন–আমার, মার, তোর বউদির, সকলেরই ইচ্ছে, হাতের কাছে এমন একটি ছেলে
কিভাবে বলে উঠবে কথাটা ঠিক করতে না পেরে ধমকাল একটু। মিসেস বাসু সঙ্গে সঙ্গে পরিপূরক সুলভ মন্তব্য করলেন, হীরের টুকরো ছেলে …
অর্চনা অপলক চোখে বিজনের দিকেই চেয়ে ছিল।–এই জন্যে ডেকেছ?
ভাবগতিক দেখে বিজন মনে মনে ঘাবড়েছে। আরো মিষ্টি করে বলল, হ্যাঁ, কথাটা তো ভেবে দেখা দরকার–
দরকার দেখতেই পাচ্ছি! তোমার স্বার্থটা কোথায় আমি জানি দাদা, কিন্তু—
স্থির কঠিন চোখে মায়ের দিকে ফিরল সে।
মিসেস বাসু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, এ আবার কি কথা। আমরা তো তোর ভালর জয়েই বলছি–
সঙ্গে সঙ্গে অর্চনা জলে উঠল যেন। এতদিনের ধৈর্যের প্রয়াস এক মুহূর্তে তছনছ হয়ে গেল।–ভালর জন্যে বলছ, আমার ভালর জঙ্গে–না মা?…মুখে চোখে নির্মম বিপ। আমার শুধু ঘরে ঘরে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় তোমার মত ক’জন মা ক’টি মেয়ের এত ভাল করছে।…আরো তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল সে, কিন্তু কেন? কেন এত ভাল করতে চাও তোমরা? কেন ভাল করার এত মোহ তোমাদের? তোমাদের ভাল করার এই নিষ্ঠুর লোভে জ্বলে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেল মা।
কণ্ঠস্বর রুদ্ধ। অন্য দুজন চিত্রার্পিত। প্রাণপণ চেষ্টায় অর্চনা সামলে নিল একটু। আস্তে আস্তে দাঁড়াল।-কিছু মনে করো না মা, আমার ভাল তোমরা অনেক করেছ…দোহাই তোমাদের, আর ভাল করতে চেয়ো না।