মা ভিতরে ঢুকে প্রসন্ন মুখে সংবাদ দিয়েছেন, ননিমাধব সকলের জন্য সিনেমার টিকিট কেটে বসে আছে, তার জন্যেই সকলের প্রতীক্ষা এখন।
সকলের অর্থাৎ দাদা বউদি। অর্চনা মায়ের মুখের ওপর একটা শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বই হাতে আবার পাশ ফিরে শুয়েছে।
মা মনে মনে শঙ্কিত।–শুয়ে পড়লি যে, শরীর খারাপ হয় নি তো?
না।
ওঠ তাহলে, চট করে মুখ হাত ধুয়ে নে–আর সময় নেই।
ওঁদের যেতে বলে।
ওদের যেতে বলব…ননিমাধব যে চারখানা টিকিট কেটে এনেছে।
বই রেখে অর্চনা আস্তে আস্তে উঠে বসেছে। মাকে নিরীক্ষণ করেছে একটু।–আমার টিকিটে তুমিই যাও তাহলে।
মিসেস বাসুর মেয়ের এই বুদ্ধি-বিবেচনার অভাবের সঙ্গেই যুঝতে হচ্ছে ক্রমাগত। বলেছেন, কি যে করি ভাল লাগে না, ওঠ
ভাল আমারও লাগে না মা।–অর্চনা চেষ্টা করেও খুব শান্ত থাকতে পারে নি, কতদিন তোমাকে নিষেধ করেছি তবু তুমি কেন এভাবে আমাকে বিরক্ত করে বলো তো?
আমি তোকে বিরক্ত করি!–মা আকাশ থেকে পড়েছেন প্রথম। তার পর সখেদে প্রস্থান–আমারও হয়েছে যেমন জালা তাই সবেতে আসি, তোর যা খুশি কর, আর কখনো যদি কিছু বলতে আসি–
কিন্তু আবারও বলতে না এসে পারেন নি তিনি। সরাসরি না বললেও চুপ করে থাকতে পারেন নি। ননিমাধবের কর দিনে দিনে বাড়ছে। এলেই চা করে দেন, ভালমন্দ খবর নেন, কারণে-অকারণে অর্চনাকে ঘরে ডাকেন। বরুণা
শুরবাড়িতে থাকে, আসে প্রায়ই, মায়ের সঙ্গে তার গোপন পরামর্শের আভাসও অর্চনা পায় একটু আধটু। . যে বরুণা ননিমাধবকে দেখলেই মুখ চোত আর দিদিকে ঠাট্টা করত, সে-ও আজকাল ঠাট্টা দূরে থাক, কিছু একটা প্রত্যাশা নিয়েই ভদ্ৰলোককে লক্ষ্য করে। পারলে একটু যেন তোয়াজ করে চলে। আর, দাদা-বউদির কথাই নেই। ননিমাধবের মত এমন লোক তায় একজনের বেশি দুজন দেখেছে বলে মনে হয় না।।
দাদা বা মায়ের বিশেষ এক ধরনের ডাক শুনলেই অর্চনা বুঝতে পারে, ঘরে কেউ আর আছে, আর সে ননিমাধব ছাড়া আর কেউ নয়। ওর ভিতরের বিরক্তি বাইরে তেমন প্রকাশ পায় না। ডাকলে সাড়া দেয়, থরে আসে, কথা বলে। আর রুমালে মুখ ঘষতে ঘষতে একখানা কর্ণা মুখ লাল হয়ে উঠেছে তাও লক্ষ্য করে।
অর্চনা আর বিয়ে করবে না এমন কথা কখনো বলে নি, এমন মনোভাবও কখনো প্রকাশ করে নি। সেই বিচ্ছেদের দিন থেকেই বলতে গেলে তার আবার বিয়ের কথা উঠেছিল। কিন্তু আইনগত বাধার আর সামাজিক চক্ষুলজ্জার খাতিরেই সম্ভবত প্রথম বছরটা কেউ সরাসরি এ-প্রস্তাব তোলে নি। তার পর তার ভাবগতিক দেখে কথাটা সামনা-সামনি তুলতে তেমন ভরসাও পেয়ে ওঠে নি কেউ। যেটুকু বলে, আভাসে ইঙ্গিতে। অর্চনা তার জবাবও দেয় না। সকলেই মনে মনে তখন তার এম এ পরীক্ষাটা শেষ হওয়ার প্রতীক্ষা করছে।
সেই বহু প্রতীক্ষার এম এ পরীক্ষাও হয়ে গেল।
ফল দেখে আনন্দে আটখানা সকলে। ননিমাধব সকালেই মস্ত এক ফুলের তোড়া এনে হাজির। মিসেস বাসু আনলে সেদিন তাকে সোজা অর্চনা ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।–তুমি তো ঘরের ছেলে, নিজের হাতেই দাও গে যাও।
সিঁড়িতে রাণু বউদি আর একদফা চাঙ্গা করেছে তাকে। উৎফুল্ল ইশারায় ঘর দেখিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ঘরেই আছে, সরাসরি গিয়ে ঢুকে পড়ুন
কিন্তু ঢুকে পড়ে অস্বস্তি অনুভব করেছে ননিমাধব। নিরাসক্ত মূখে পরীক্ষা পাসের কোন আনন্দ চোখে পড়ে নি। দোরগোড়া থেকে একটু নিরীক্ষণ করে ঢোঁক গিলে বলেছে, আসব?
অর্চনা অন্যদিকে ফিরে ছিল। ফুলের তোড়া হাতে তাকে দেখে একটু থেমে বলেছে, আসুন–
ননিমাধব আরক্ত মুখে তোড়া এগিয়ে দিয়েছে।
ফুল হাতে নিয়ে অর্চনা খুশীর ভাব দেখাতেও চেষ্টা করেছে একটু।…কি ব্যাপার–
সকালে উঠেই এম এ রেজাল্ট দেখলাম—
ও…। অর্চনা মুখ হাসির মতই। সহজভাবে বলল, এ পাবার মত একমন কিছু রেজাল্ট হয়নি।
ননিমাধবের সলজ্জ বিস্ময়ে, সে কি! ফার্স্ট ক্লাস–
অর্চনা বলতে যাচ্ছিল, ফার্স্ট ক্লাস ফি-বছরই দুই-একজন পায়। কিন্তু রুমালের খোঁজে পকেটে হাত ঢুকতে দেখে বলা হল না। ওদিকে উৎফুল্ল আনন্দে দিদিকে ডাকতে ডাকতে বলাও হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। ফুল এবং ননিমাধবকে দেখে যেমন খুশী তেমনি অপ্রস্তুত।
আপনি। আমি এসেছিলাম দিদিকে কংগ্রাচুলেট করতে—
ননিমাধব বলল, আমিও।
অর্চনা তাকের থেকে ফুলদানি এনে টেবিলে ফুলের তোড়া রাখছিল। বরুণা খুশী মুখে ননিমাধবকে আপ্যায়ন করল। টেবিলসংলগ্ন চেয়ার আর বিছানা ছাড়া বসার আর জায়গা না দেখে ননিমাধব ইতস্তত করছিল।
বাইরে থেকে বিজনের ডাকাডাকিতে ছন্দপতন। সাড়া দিয়ে বিরসবদনে প্রস্থান করতে হল তাকে।
বরুণা হেসে ওঠার মুখেও সামলে নিল, দিদির গম্ভীর মুখের দিকে তাকালে হাসি আসে না। অর্চনা বিছানায় বসে তাকে ডাকল, বোস, তোর কি খবর?
তার গা ঘেঁষে বসল বরুণা।–খবর তো আজ তোর, বা-ব্বা কি পড়াই পড়লি দুবছর ধরে।…তার আরো কাছে এসে উৎসুক মুখে জিজ্ঞাসা করল, দিদি, বাবা খুব খুশী হয়েছেন রেজাল্ট শুনে?
কি জানি…
বরুণা থমকে তাকাল।
একটা উদগত অনুভূতি সামলে নিয়ে অর্চনা হাসল একটু, তারপর আস্তে আস্তে বলল, যারা এই দু বছরের মধ্যে একটা দিনও আমার সঙ্গে ডেকে কথা কন্ নি রে।
বরুণা জানত। আর বাবার ওপর রাগই হল তার। উঠে দাঁড়াতে গেল, তাই বুঝি, বাবাকে দেখাচ্ছি মজা–