অর্চনা তার নিজের ঘরে। বিয়ের আগে যে-ঘরে থাকত। নিচের জটলায় তারও নিঃসঙ্কোচ উপস্থিতি সকলের কাম্য ছিল। বিশেষ করে মায়ের আর দাদার। যার জন্য এত বড় গুরুভার লাঘব করার চেষ্টা, সে একপাশে সরে থাকলে নিস্পত্তিটা খুব সহজ মনে হয় না।
আর অনুপস্থিত বাড়ির কর্তা ডক্টর বাসু। অবশ্য এ-সভায় তিনি অবাঞ্ছিতও বটেন। তাঁর অনুমোদন ছিল না সেটা সকলেই জানত। কিন্তু আজ আর তাকে আমল দিচ্ছে কে, হুট করে এমন একটা বিয়ে দিয়ে বসেছিলেন বলেই তো এ রকমটা ঘটল। নিজের ঘরে বসে স্তব্ধ বিষণ্ণতায় চুরুট টানছেন। ইদানীং ঘন ঘন চুরুট ফুরোচ্ছে। দাণ্ডকে পাঠিয়েছেন বাক্স ভরে চুরুট কিনে নিয়ে আসতে।
তিনি না এলেও মিসেস বাসু অব্যাহতি দেন নি। তাঁর কাছে এলে থেকে থেকে জ্বলে উঠেছেন, সেই অমানুষ লোকটার বিরুদ্ধে যে একটা দিন শান্তিতে থাকতে দেয় নি তার মেয়েকে-এবারে হাড় জুড়োবে। সমর্থন না পেয়ে স্বামীর ওপরেই আগুন।–যত কিছুর মূলে তুমি, তুমি তো চুপ করে থাকবেই এখন!
ডক্টর বাসু তার পরেও চুপ করে থাকেন নি। গল্পীর আদেশের স্বরে বলেছেন, তুমি দয়া করে যাবে এখান থেকে?
মিসেস বাসু হকচকিয়ে গেছেন। এ-ধরনের কণ্ঠস্বর বড় শোনেন নি। মুখে যতই বলুন, মেয়ের জন্য দুর্ভাবনায় ভিতরে ভিতরে মায়ের মন শুকিয়েছিল বটেই। অসহায় ক্ষোভে সেটুকুই প্রকাশ হয়ে গেছে।-ও… আমাকে বুঝি এখন তোমার সহ্য হচ্ছে না! কোথা থেকে একটা অপদার্থ অমানুষ ধরে এনে সংসারটাকে একেবারে তছনছ করে দিলে, অপমানে অপমানে মেয়েটার হাড় কালি-তার দিকে একবারও চেয়ে দেখেছ তুমি?
নারীর বল চোখের জল। কান্নার বেগ সামলাবার জন্যে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন।
বাড়ির মধ্যে সেদিন বিমর্ষ দেখা গেছে আর একজনকে। দাঁত। বাক্স ভরা চুরুটের গোটাকতক অন্তত তার পকেটেই থাকার কথা। কিন্তু খেয়াল ছিল না। দিদিমণির ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে গতি তার আপনি মন্থর হয়েছে।…জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে, বাইরে থেকে সে-মুখের আভাস দেখা যায় শুধু। চুরুটের বাক্সটার দিকে চেয়ে আর-একদিনের স্মৃতি তার মনে পড়েছে। বড় মিষ্টি স্মৃতি। সেদিনের পাওয়ার আনন্দে দিদিমণি নিজের হাতে ওর পকেটে একটা চুরুট গুঁজে দিয়েছিল।
নিচের ঘরে বরুণার উত্তেজনা এবং আক্রোশ দুই-ই স্বতঃস্ফুর্ত। বার বার বলেছে– ঠিক হয়েছে, খুব ভাল হয়েছে, যেমন লোক তেমন শিক্ষা হয়েছে। তার দিদিকে হেনস্থা করেছে যে লোকটা তার কত বড় শিক্ষা হল সেটা ভেবে ডগমগিয়ে উঠছে থেকে থেকে। বিজনকে জিজ্ঞাসা করেছে-আচ্ছা, খবরটা কাগজে বেরুবে?
অদূরে বসে তার স্বামী বেচারা যে ওর আনন্দ-মিশ্রিত উত্তেজনাটুকু করুণ নেত্রে লক্ষ্য করছে সেদিকে খেয়াল নেই।
স্বামীর কাছে অবর্ষণ করতে হলেও ছেলের কাছে সত্যিকারের সান্ত্বনা পেয়েছেন মিসেস বাসু। বিজন বলেছে–অত মুষড়ে পড়লে চলে, এ-রকম তো আজকাল হামেশাই হচ্ছে। এই তো কোর্টে দেখে এলে তিন হাজার খুলছে এই কেস, তারা কি সব চোখে অন্ধকার দেখছে?
ভরসার অঙ্কটার ওপরেই জোর দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রাণু দেবী। তিন হাজার।
কম করে। তোমরা তো তবু চট করেই রেহাই পেয়ে গেলে-যা হবার হয়ে গেল, ভালই হল। তারপর আভাসে ইঙ্গিতে বিজন আশ্বস্ত করেছে মাকে। বলেছে, আইনের কড়াকড়ির সময়টা পেরুলেই এমন বিয়ে দেবে অর্চনার যাতে গায়ে আর আঁচটি না লাগে সারা জীবনে।
এত বড় আশ্বাসের গাত্রটি কে তাও সকলেই জানে।
দিন কাটতে লাগল।
এর মধ্যে দুটি পরিবর্তন হয়েছে। এক, বাসা-বদল। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে বিপরীত এলাকায় বিজন বড় বাড়ি ভাড়া করেছে। নিজেদের বাড়ি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের বাসনা। তাছাড়া পূর্বস্মৃতির কাছাকাছির মধ্যে না থাকাই বাঞ্ছনীয়, নতুন পরিবেশে অর্চনারও কিছুটা পরিবর্তন সম্ভব।
দ্বিতীয়, অর্চনা আবার এম. এ. পড়া শুরু করেছে।
দিন যায়। অর্চনার মনে হত, কি করছে সেই মানুষটা, মনে মনে কেমন জ্বলছে, জানতে পেলে হত। জানার উপায় নেই বলেই নিজে জ্বলত। জীবন থেকে যাকে ধুয়ে মুছে ফেলেছে, মন থেকে তাকে বিদায় দেওয়াটা সম্পূর্ণ হচ্ছে না বলেই আরো জ্বালা। পার্টি ভাল লাগে না, ক্লাব না, থিয়েটার না। বই পড়ে। দিনরাত্রির বেশির ভাগই বই নিয়ে কাটে। য়ুনিভার্সিটি লাইব্রেরি থেকে আসতেও বেশ রাত হয় এক-একদিন। কিন্তু বইও ভাল লাগে না সক সময়।
সকলেরই একটা চোখ আছে তার দিকে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে যে একজনের সস্নেহ দৃষ্টি আর আহ্বানের আশায় ভিতরটা প্রতীক্ষাতুর সর্বদা, তিনি যেন চেনেনও না ওকে। তিনি বাবা। সামনাসামনি হলেও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যান। বিরক্তও হন! অর্চনা পারলে তার সামনে আসে না। বাবা ঘরে না থাকলে সংগোপনে তার ঘর গুছিয়ে রেখে আসে। তার পর একটা দুর্বহ বেদনা বুকে চেপে নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বসে থাকে।
বাবার উপেক্ষা মা অবশ্য দ্বিগুণ পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। নতুন বৈচিত্র্যের সন্ধানে মাঝে মাঝে কিছু একটা প্রোগ্রাম করে মেয়ের মত নিতে আসেন প্রায়ই। অর্চনা কখনো নিস্পৃহভাবে চুপ করে থাকে, আবার অকারণে ঝাঁঝিয়েও ওঠে এক-একদিন। ননিমাধবের সিনেমার টিকিট কেনা নিয়ে সেদিনও মায়ের সঙ্গে একপ্রস্থ হয়ে গেছে। অৰ্চনা সবে যুনিভার্সিটি থেকে ফিরেছিল। ননিমাধবের গাড়িটা প্রায়ই যেমন দাঁড়ানো দেখে, সেদিনও তেমনি দেখেছিল। নিজের ঘরে এসেই একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়েছিল সে।