বিছানা উল্টে-পাল্টে অর্চনা চাবি খুজছে। অবাক একটু।
এদিকে দেরি দেখে সাবি তাড়া দিতে এসে জিজ্ঞাসা করল কি খুঁজছ, চাবি?
কিছু না বলে অর্চনা শুধু তাকাল তার দিকে।
সাবি জানাল, বউদিমণি ধরে ছিল না বলে দাদাবাবু বিছানার নিচে থেকে চাৰিটা তাকেই এনে দিতে বলেছিল। চাবি দাদাবাবুর কাছেই।
অর্চনার মুখের দিকে চেয়ে সাবি যে-জন্যে এসেছিল তা আর বলা হল না, পায়ে পায়ে প্রানি করল। অর্চনা খাটের বাহু ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় বসে পড়ল। নির্বাক, অনুভূতিশূন্য।…শুধু এটুকুই বাকি ছিল। এইটুকুই শুধু বাকি ছিল। মাঝের দরজার দিকে চোখ গেল।
দরজা বন্ধ।
বিকেল থেকেই আকাশের রঙ অন্যরকম। সূর্যাস্তসীমার ওধারে কালো মেঘের ভিড়। একটার সঙ্গে আব একটা জুড়েছে, আর একটার সঙ্গে আর একটা। ছেঁড়া ত্বকের মত মেঘের গা-ছেঁড়া দগদগে লাল আলো। বিকেল শেষ হতে না হতে পাটকিলে রঙের অন্ধকারে ঘর ছেয়ে গেল।
অর্চনা উঠল এক সময়। আলো জ্বালল।
ও-ঘরের আলো জ্বলতে সে এসেছে টের পেল। আবার বেরুলো, তাও। ঘণ্টা দুই বাদে ফিরে আসাটাও। সাবি যথারীতি রাতের খাবার রেখে এ-ঘরে এলে তাগিদ দিতে। দুপুরেও খাওয়া হয় নি বউদিমণির, তাই রাত্রিতে আর ভাত ঢেকে রেখে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না সে। অর্চনা জানালার কাছ থেকে একবার ফিরে তাকিয়েছে শুধু। একটা অজ্ঞাত অস্বস্তি চেপে সাবি ফিরে গেছে।
দূরে দূরে ক্ষীণদ্যুতি তারাগুলোর অসময়ে ঘরে ফেরার তাড়া। টুপটুপ করে একটার পর একটা নিবেছে। মেঘের পায়তাড়া চলছে সেই থেকে। টিপটিপ দুই এক ফোঁটা পড়ছে কখনো-সখনো। বর্ষণের নাম নেই, ভ্রুকুটি বেশি।
রাস্তার লোক-চলাচল কমে আসছে।
টেবিলের টাইমপীস ঘড়িটায় রাত দশটা বাজে।
সুখেন্দু ঈজিচেয়ারে শুয়ে নিবিষ্ট মনে বই পড়ছে। শান্ত মুখে অর্চনা বারান্দা দিয়ে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। বাইরে থেকেই দু-চার মুহূর্ত দেখল। তারপর ঘরে ঢুকে পায়ে পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
বই নামাও। কথা আছে!
সুখেন্দু বই নামাল, তাকাল।
খুব শান্ত কণ্ঠে অর্চনা বলল, বিয়ের পর থেকে আমাদের বনিবনা হল না, সেটা বোধ হয় আর বলে দিতে হবে না?
একটু থেমে নিস্পৃহ জবাব দিল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
অৰ্চনার দুই চোখ তার মুখের ওপর সংবদ্ধ।–তাহলে চিরকার এভাবে চলতে পারে না বোধ হয়?
সুখেন্দু নিরুত্তর। চেয়ে আছে।
অর্চনার মুখের একটা শিরাও কাঁপছে না। কণ্ঠস্বর আরো ঠাণ্ডা, আরো নরম। বলল, আমাদের তাহলে ছাড়াছাড়ি হওয়াই ভাল, কেমন?
সুখের মুখে চকিত রুক্ষ ছায়া পড়ল একটা। তার পর স্থির সে-ও।– কি করে?
অর্চনা তেমনি শান্তমুখে বলল, আইনে যেমন করে হয়।
আত্মস্ত হবার জন্য সুখেন্দু হাতের বইখানা টেবিলে রাখল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরে পায়চারি করল একবার। আবার বসল। ভাবল কিছুক্ষণ।
অর্চনা জবাবের প্রতীক্ষা করছে।
সুখেন্দু জবাব দিল। বলল, যদি তাই চাও আমার দিক থেকে কোন বাধা আসবে না।
আর একটুও অপেক্ষা না করে ধীর শিথিল পায়ে অর্চনা এ-ঘরে চলে এলো। টেবিলের সামনের চেয়ারটাতে বসল। ভাবলেশহীন পাথরের মূর্তি।
বেশিক্ষণ বসে থাকা গেল না। উঠল। আস্তে আস্তে আবার ওই জানালার কাছেই দাঁড়াল।
দাঁড়িয়ে আছে।
রাত বাড়ছে। নিচের রাস্তাটা নিঝুম। অবসানের মুহূর্তগুলি শূন্যতার মন্ত্রে নিটোল ভরাট হয়ে উঠছে ক্রমশ।
স্তব্ধতায় ছেদ পড়তে লাগল। বাতাস দিয়েছে। বিকেল থেকে আকাশের যে সাজ-সরঞ্জাম শুরু হয়েছিল সেখানে তাড়া পড়েছে। অনার হুঁশ নেই। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তেমনি। খোলা চুল উড়ছে। শাড়ির আঁচলের অর্ধেক মাটিতে লুটিয়েছে।
বাতাসের জোর বাড়তে লাগল। মেঘে মেঘে বিদ্যুতের চলাফেরা, বাতাসে ঝড়ের সংকেত। অদূরে গাছ দুটোর সসড় মাতামাতি। লাইট পোস্টের আলোগুলো কবলিত মেয়ের মত বিড়ম্বিত, নিষ্প্রভ।
ঝোড়ো বাতাসে আর বৃষ্টির ঝাপটায় অর্চনার সম্বিৎ ফিরল।
জানালা বন্ধ করে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়াল। দু চোখ মাঝের বন্ধ দরজা থেকে ফিরে এলো। টেবিলের টাইমপীস ঘড়িতে রাত্রি একটা। পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলো সে। সুখের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল আবার। ঘরে আলো জ্বলছে।
বই-কোলে ঈজিচেয়ারে শুয়ে সুখেন্দু অধোরে ঘুমুচ্ছে। ঘরের খোলা জানালা দিয়ে ঝড়জলের ঝাপটা আসছে। অর্চনা ঘরে ঢুকে জানালা বন্ধ করল। ফিরে আসার মুখে ঈজিচেয়ারের সামনে দাঁড়াল একটু। দেখল চেয়ে চেয়ে। তারপর বিছানা থেকে পাতলা চাদরটা তুলে নিয়ে তার গায়ে ঢেকে দিয়ে আস্তে আছে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
৮-৯. বিচ্ছেদের পরোয়ানা
০৮.
দু পক্ষের অনুমোদনের ফলে যা ঘটবার সহজেই ঘটে গেছে।
বিচ্ছেদের পরোয়ানা বেরিয়েছে।
বাপের বাড়ির আবহাওয়া রীতিমত গরম সেদিন। বাড়িতে যেন সাড়া পড়ে গেছে একটা। বিজনের উত্তেজনা, বরুণার উত্তেজনা, মায়ের উত্তেজনা। বিজন পারলে তক্ষুনি আর একটা বিয়ে দিয়ে দেয় অর্চনার। হাতের কাছে তেমন পাত্র মজুত নেই নাকি?
আছে সকলেই জানে। এমন একটা দিনে ননিমাধবও এসেছে। তার ফস। মুখখানি একটু বেশি লাল হয়েছে, পকেট থেকে ঘন ঘন রুমাল বেরিয়েছে। ওদিকে শুভার্থী আত্মীয়-পরিজনও কেউ কেউ এসেছেন। আজকালকার দিনে এটা যে এমন কিছু ব্যাপার নয়, বার বার সে-কথাই ঘোষণা করে গেছেন তারা।