স্থির নেত্রে খানিক চেয়ে থেকে সুখেন্দু জবাব দিল, না। পিসিমাকে যেদিন তাড়াতে গেছে সে দায়িত্ব সেদিনই গেছে।
কি বললে।… অর্চনা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল প্রায়।
উত্তেজনা দমন করার জন্য সুখেন্দু উঠে মেঝে থেকে বইটাই কুড়িয়ে আনল আবার।
অর্চনার দুই চোখে সাদা আগুন। অনুচ্চ স্বরে বলল, তুমি অতি ছোট অতি নীচ…
আর দাঁড়ানো সম্ভব হল না, এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে।
.
ভাঙার পর্ব শেষ।
সকল সংগতির মাঝখান দিয়ে ভবিতব্যের ছুরি চালানো শেষ।
যে-কোন তুচ্ছ উপলক্ষে শান্ত বিচ্ছিন্নতা সম্ভব এখন।
এর পরের তিন মাসে, একটা নয়, এমনি অনেকগুলো উপলক্ষের সূচনা। পাশা পাশি দুটি ধরের দিনাবসানের মাঝে নির্বাক চিত্রের মতই সেগুলির আনাগোনা। অর্চনা নির্বাক দ্রষ্টা।
… চা নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে, আর একজন বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নামছে। চায়ের সরঞ্জাম হাতে অর্চনা দেওয়ালের দিকে একটু ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সুখে নেমে চলে গেছে। অর্চনা দাঁড়িয়ে দেখেছে। তারপর আস্তে আস্তে দোতলার বারান্দায় এসে দেয়ালের ধারে চায়ের সরঞ্জাম নামিয়ে রেখে নিজের ঘরে এসে বসেছে। ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে বুকের জামা ধরে ছদ্ম অনুশাসনে এই একজনকেই ওপরে টেনে নিয়ে এসেছিল। এই সেদিনের কথা, দু-বছরও নয়। কিন্তু বহুদিন যেন-বহু-দুরের কোন এক দিন।
…রাতে নিচের খাবারের টেবিলে দুজনের মুখোমুখি বসে আহারের যোগ টুকুও বিচ্ছিন্ন। অর্চনা যথাসময়ে টেবিলে প্রতীক্ষা করেছে। সাবি এসে টেবিল থেকে সুখেন্দুর খালাবাটি সব তুলে নিয়ে গেছে।–দাদাবাবু ওপরে খাবেন, দিয়ে আসতে বলেছেন–নিয়ে গেছে। অর্চনা চেয়ে চেয়ে দেখেছে। সে-দিন অন্তত ওর খাওয়া আর হয় নি। উঠে চুপচাপ নিজের ঘরের পাটের কোণে এসে বসেছে। ও-ঘরের আহার সমাধা হল টের পেয়েছে–তারপর ঈজিচেয়ারে বসে রাতের পাঠে মগ্ন। আলো নিবেছে এক সময়।…গাত্রোখান, শয্যালয়, ঘুম। এ-ঘরের আলো জ্বলছে। মাঝের দরজা দিয়ে সেই আলোর খানিকটা ও-ঘরে গিয়ে পড়েছে। সেই আলোর ওপর ছায়া পড়েছে একটা। মাঝের দরজায় অর্চনা এসে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েই আছে। ও-ঘরে সুপ্তির ব্যাঘাত ঘটে নি।
…খাটে অর্চনা বসে নিষ্প্রাণ মূর্তির মত, তার সামনেই একটা চেয়ারে বিজন বসে। সে-ও বিস্মিত, কিছুটা বিভ্রান্ত। কলেজ থেকে সুখেন টেলিফোনে বিজনকে জানিয়েছে, শিগগিরই সে এক মাসের জন্য বাইরে যাচ্ছে, কেউ এসে যেন অর্চনাকে নিয়ে যায়। বিজন নিতে এসেছে। অথবা অর্চনা কিছুই জানে না। তাই বিস্ময়, সেই সঙ্গে অস্বস্তি। এ-বাড়ির বাতাসের গতি তারাও উপলব্ধি করতে পারে। মা হাল ছাড়তে বাবা নিজেই হাল ধরতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অর্চনাই জামাইয়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ঘটতে দেয় নি তার। নীরবে মাথা নেড়ে বাধা দিয়েছে। অস্বস্তি চেপে বিজন বসে থাকতে পারে নি বেশিক্ষণ, বলে গেছে, সুখেন্দু চলে গেলেই না হয় এসে তাকে নিয়ে যাবে। অর্চনা জবাব দেয় নি। কখন উঠে চলে গেছে তাও হুঁশ নেই।
উপলক্ষগুলি এই রকমের।
এমনি আরো দুটি ঘটনার পর উপলক্ষেরও প্রয়োজন থাকল না আর। একটা রাতের ঘটনা, অন্যটা দিনের।
ঘরের আলো নিবিয়ে সুখেন্দু শুয়ে পড়তেই মাঝের দরজা দিয়ে ও-ঘরে আলোর ঝলক তার অন্ধকার শয্যার কাছাকাছি এসে থেমে আছে। বিছানায় গা ঠেকালেই ঘুম হয়, তবু কি জানি কেন সেদিন ওই আলোটুকুই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে লাগল এবং বিরক্তির কারণ হয়ে উঠল। শেষে একসময় উঠে এসে সরাসরি দরজাটা বন্ধ করে দিল।
অর্চনা জানালার কাছে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল। কিছুই দেখছিল না, এমনিই দাঁড়িয়েছিল। শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেবে, মাঝে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। নিজের অগোচরে দুই-এক পা সরে এলো। নিল র পর।. পাকাপাকি ব্যবধান রচনা, পাকাপোক্ত জবাব। দরজা বন্ধ হতে ঘরের আলোটা জোরালো লাগছে, হলদে, দরজাটা চকচক করছে। একটা অশুভ ইজিত চকচকিয়ে উঠছে যেন।
অর্চনা আলোটা নিবিয়ে দিল।
পরদিন।
অর্চনা তখন নিচে স্নানের ঘরে।
মেঝেতে উবুড় হয়ে সুখেন্দু মায়ের সাবেকী আমলের বড় ট্রাঙ্কটা খুলে বসেছিল। ট্রাঙ্কটা তার এই ঘরেই। গরম জামা-কাপড় সব ওতেই থাকে। বাইরে বেরুতে হলে যা-যা নেবে বার করে রোদে দিয়ে ঠিকঠাক করে রাখা দরকার। তাছাড়া কি আছে না আছে তাও স্মরণ নেই।
তার পিছনে সাবি দাঁড়িয়েছিল। একটু অপেক্ষা করে সে যে চলে গেছে সুখেন্দুর খেয়াল নেই। মেঝের চাবির গোছাটা একটু জোরেই পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, এটা রেখে এসো।
চাবিটা সড়সড় করে টেবিলের নিচে গিয়ে থামল। যা-যা বার করেছিল একবার পরীক্ষা কবে সুখেন্দু সেগুলো নিয়ে ছাতে উঠে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁটা হাতে হরিয়া ঘরে ঢুকেছে। দাদাবাবু দু-দশ মিনিটের জন্যে ঘর থেকে না বেরুলে ঘর ঝাঁট দেবার অবকাশ হয় না। এই কাজটুকু সারবার জন্য সকালের মধ্যে অনেকবারই ফিরে যেতে হয় আর সুযোগের প্রতীক্ষা করতে হয়।
টেবিলের নিচে চাবিটা চোখে পড়ল। হরিয়া ওটা তুলে সামনের দোলকের কোণে রেখে দিয়ে গেল।
অর্চনার সেই চাবির খোঁজ পড়ল দুপুরে খেতে নামার আগে। মোজই খেতে যাবার আগে চাবি নিয়ে নামে। আসার সময় ভাড়ার রামার সব বন্ধ করে আসে।