বর এসেছে শুনে দোতলার মেয়েরা সব হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। হাতের গেলাস বাঁচিয়ে অর্চনার উপরে উঠতেও কম সময় লাগল না। তাদের বর দেখার হিড়িকে কনে-সাজে বরুণা ঘরে একা বসে। দিদির মুখের ওপর চোখ রেখে সরবতের গেলাস হাতে নিল। তার পর ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল দিদি, জামাইবাবু এলো না রে?
অর্চনা থমকে তাকাল একটু। তার পর অনুশাসনের সুরে বলল, তোমার নিজের ভাবনা ভাব এখন–ওদিকে এসে গেছে।
দাঁড়াবার সময় নেই যেন, তাড়াতাড়ি বাইরে এলো। নিজের অজ্ঞাতেই বোধ হয় বাবার ঘরের কাছাকাছি এসেছিল, সেইখানেও এই একজনের অনুপস্থিতির কারণে বাবা মায়ের বচসা কানে এলো… অর্চনা চুপচাপ সরে গেল। ডক্টর বাসু ঘরে এসেছিলেন আর একবার টেলিফোন করতে। টের পেয়ে মিসেস বাই সেই নিরিবিলিতে এসে চড়াও হয়েছেন।
তিনবার তো টেলিফোন করলাম, সাড়া না পেলে কি করব?–ডক্টর বাসু বিরক্ত।
সাড়া না দিলে সাড়া পাবে কি করে!–রাগে অপমানে মিসেস বাসু ক্ষিপ্ত। –আমাদের মুখে চুনকালি দেবার জন্যেই এ বিয়েতে সে আসছে না জেনে রাখো। কি লজ্জা, কি লজ্জা! যার সঙ্গে দেখা হয় সে-ই জিজ্ঞাসা করে বড় জামাই কোথায়? আমি আগেই জানতুম সে আসবে না–ওরা আজকাল একঘরে থাকে না পর্যন্ত সে খবর রাখো?
খবরটা ডক্টর বাসু স্ত্রীর মুখেই আজ পর্যন্ত অনেকবার শুনেছেন। বললেন, এ সব কথা থাক এখন, ওদিকে ডাকাডাকি পড়ে গেছে।
বিয়ের লগ্নও উপস্থিত একসময়। ছাদে বিয়ে। বাড়িসুদ্ধ লোক সেখানে ভি করেছে। এদিকটা ফাঁকা। অর্চনা পায়ে পায়ে বাবার ঘরে চলে এলো। আন্তে আস্তে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল। নম্বর ডায়েল করল।
টেলিফোন বেজে চলেছে। অর্চনার শান্ত প্রতীক্ষা। ওদিক থেকে রিসিভার তোলার শব্দ এলো কানে। কণ্ঠস্বরের অপেক্ষায় সাতে করে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল।
কণ্ঠস্বর নয়, ওদিকে রিসিভারটা ঠক করে টেবিলে নামিয়ে রাখার শব্দ একটা। অর্চনা ফ্যাল ফ্যাল করে নিজের হাতের রিসিভারের দিকে চেয়ে রইল খানিক, আবারও কানে লাগাল ওটা। আর কোন সাড়াশব্দ নেই।
রিসিভার যথাস্থানে নামিয়ে রেখে বাবার বিছানায় এসে বসল সে।
কিছু একটা কাজেই হয়তো মিসেস বাসু ব্যস্তমুখে ঘরে ঢুকেছিলেন। মেয়েকে ও-ভাবে বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। নীরব দৃষ্টি-বিনিময়। রুদ্ধ আক্রোশে যেন হিসহিসিয়ে উঠলেন তিনি, জামাই বলে তাকে আমি ছেড়ে দেব না, এ অপমানের কৈফিয়ত আমি নিয়ে ছাড়ব।
অর্চনা চেয়েই আছে।
মিসেস বাসু কটুক্তি করে উঠলেন, আগে যদি জানতুম এত ছোট, এত নীচ–
মা!
মা থতমত খেয়ে থেমে গেলেন। অর্চনা তাঁর পাশ কাটিয়ে সবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
অসহিষ্ণু প্রতীক্ষা। বিয়ে হয়ে গেছে। বরকনেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হালফ্যাশানের বিয়ে, রাত দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে বিয়েবাড়ি অনেকটা হালকা। অর্চনা চুপচাপ নিচে নেমে এলো। ড্রাইভারকে ইশারায় ডেকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। এত গাড়ি আসছে যাচ্ছে তখন–কেউ লক্ষ্য করল না।
.
দরজা খুলে সাবি বিস্ময় প্রকাশ করার আগেই অর্চনা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
বারান্দার দিকের দুটো ঘরের দরজাই আবজানো। দুই-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে অর্চনা নিজের ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে এসে দাঁড়াল। ঘরে আলো জ্বলছে। পাশের ঘরেও। টেবিলের ওপর চোখ পড়তেই স্তব্ধ রোষে সমস্ত মুখ কাগজের মত সাদা।
টেলিফোনের রিসিভারটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে তখনো। মাঝের দরজার দিকে এক ঝলক আগুন ছড়িয়ে রিসিভার তুলে রাখল। তার পর এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
সুখেন্দু ঈজিচেয়ারে বসে বই পড়ছে।
অর্চনার শিরায় শিরায় রক্তের বদলে আগুনের স্রোত। এক ঝটকায় তার হাত থেকে বইটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রায় চীৎকার করে উঠল, আমি জানতে চাই এর অর্থ কি?
সুখেন্দু চমকেই উঠেছিল। চুপচাপ তার মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে উঠে মেঝে থেকে বইটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার এসে বসল।-কিসের অর্থ?
আমাকে এভাবে অপমান করার অর্থ কি?
অপমান কিসের…তোমাদের ও-বাড়িতে যে আমি যাব না এ তুমি জানতে না?
কেন? কেন যাবে না?–অর্চনা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল আবারও।
হাতের বইটা টেবিলে রেখে সুখেন্দু জবাব দিল, যাব না তার কারণ সেখানে গেলে তোমার মা যে-ভাব দেখান, যে-ব্যবহার করেন আর যে-উপদেশ দেন তাতে আমিও খানিকটা অপমান বোধ করি।
আমার মা উপদেশ দেবে না তো উপদেশ দেবে বাইরের লোক এসে?
উপদেশ হলে কিছু বলতাম না, তিনি অপমান করেন–তোমাদের ও-বাড়ি আমি বরদাস্ত করতে পারি নে।
তা পারবে কেন?…রাগে কাঁপছে অর্চনা, নিজের নেই বলে যাদের আছে হিংসেয় তাদের কাছেও ঘেঁষতে চাও না, কেমন?
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সুখেন্দু রূঢ় কঠিন জবাব দিল, হিংসে করার মত তোমাদের কিছু নেই, সেটা জানলে এ কথা বলতে না। আমার বরদাস্ত করার থেকেও, তুমি আমার মত একজনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারবে কি না সে কথাটাই তোমার আর তোমার বাবা-মায়ের আগে ভাবা উচিত ছিল।
কোন্ কথায় কোন কথা আসছে কারো হুঁশ নেই। আত্মসংবরণের চেষ্টায় অর্চনা টেবিলে একটা হাত রাখতে সেই বইটাই হাতে ঠেকল আবার। উষ্ণ ঠেলায় টেবিল থেকে পাঁচ হাত দূরে মাটিতে ছিটকে পড়ল ওটা। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, বাবা-মার কথা থাক, আমি নিজে সব দিক ভেবেই এ-বাড়িতে এসেছিলাম সেটা তুমি টের পাও নি? কিন্তু তুমি? আজ এত বড় অপমানের মধ্যে আমাকে ঠেলে দিতেও তোমার মায়া হয় নি। মানিয়ে চলার দায়িত্ব শুধু আমারই, তোমার নয়?