মানে তোমরাই জানো।
আমরা কারা?
ঘাড় ফিরিয়ে সুখে আবারও তাকাল তার দিকে।–তোমরা, তুমি আর তোমার মা।…অসহিষ্ণু হাতে কলমটা তুলে নিয়ে লেখার দিকে ঝুকল সে।
অর্চনা বেদনাহত, নিস্পন্দ। অব্যক্ত ব্যথায় খানিক চেয়ে রইল তার দিকে। তার পর মাঝের দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে পাশের ঘরে চলে এলো। শয্যায় বসল। এ আঘাতের যেন সীমা-পরিসীমা নেই।
দেয়ালের সেই পুরানো জায়গায় শাশুড়ীর ছবি। যাবার সময় মনে মনে আশা ছিল ফিরে এসে এই ছবি এখানেই দেখবে আবার। তাই দেখল। কিন্তু এরও আর যেন কোন সান্ত্বনা নেই। ছবি অনেক-অনেক দূরে সরে গেছে। সবই অনেক দূরে সরে গেছে।
বসে আছে মূর্তির মত। ছবির দিকেই চেয়ে আছে।
দুই চোখ-ভরা জল।
৭. বরুণার বিয়ে
০৭.
বরুণার বিয়ে।
বিয়েবাড়ির আনন্দটা ঠিক কানায় কানায় ভরে ওঠে নি। অবশ্য আমন্ত্রিত অভ্যাগতজনেরা কেউ কিছু অনুভব করেন নি। বিজন আর ননিমাধবের সাড়ম্বর ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি নেই। সেদিক থেকে বিয়ে-বাড়ি সরগরম। আদর-অভ্যর্থনা, হাসি-খুশ, মাঙ্গলিক, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনির ছড়াছড়ি।
এরই তলায় তলায় শুধু বাড়ির মানুষ ক’টির মনে একটা চাপা অস্বস্তি ক্রমশ থিতিয়ে উঠেছে। এমন কি ঘর্মাক্তকলেবর দাশু পর্যন্ত সহস্র কাজের ফাঁকে গাছকোমর শাড়ি-জড়ানো কর্মব্যস্ত বড় দিদিমণিকে দেখে বিমনা একটু। ও সামনাসামনি হলে বিজনের মুখে গাম্ভীর্যের ছায়া পড়ছে, মিসেস বাসু কলমুখর ব্যস্ততার মধ্যেও স্পষ্টই কিছু বলার ফাঁক খুঁজেছেন, আর ডক্টর বাসুও ওর দিকে চেয়েই অন্যমনস্ক হয়েছেন।
বিয়ে-বাড়িতে এখনো একজনের দেখা নেই।
সকলের সংশয়, হয়তো এর পর আর আসবেও না।
অর্চনাই শুধু এখনো ভাবছে না যে আসবে না। ভাবতে পারছে না।
পিসিমা যাবার পর থেকে এ পর্যন্ত একটা রাতও সে বাপের বাড়িতে থাকে নি। মায়ের ক্ষোভ, দাদা-বউদির অনুরোধ, বরুণার অভিমান, এমন কি বাবার অনুরোধ সত্ত্বেও না। শেষের এই কটা দিনও খুব সকালে এসেছে আর যত রাতই হোক ফিরে গেছে। আর সেই কারণে ঘরের মানুষটাকে ভিতরে ভিতরে সদয়ও মনে হয়েছে একটু। ওর এত পরিশ্রম আর ছোটাছুটি দেখে দিনতিনেক আগেও সে ওকে বলেছে, এই কটা দিন তুমি সেখানে থাকতে পার, আমার কোন অসুবিধে হবে না।
অর্চনা নিরুত্তাপ জবাব দিয়েছে, আমার হবে।
প্রগলভ সান্নিধ্যে এসে অর্চনা হয়তো অন্য কিছু বলতে পারত। আরো নরম, আরে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আসার মতই কিছু। কিন্তু ইতিমধ্যে পিসিমার কাছে চিঠি লেখা, পিসিমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা বা ওর নিজের হরিদ্বারে যাওয়া নিয়ে আরো একাধিক রাত্রি নিঃশব্দে ওকে চোখের জল ফেলতে হয়েছে। সবকটা আবেদনের বিকৃত প্রতিফলনে রূঢ় আঘাত পেয়েই ফিরে আসতে হয়েছে। সে-আঘাত আজও থেকে থেকে টনটনিয়ে ওঠে।
দিনসাতেক আগে বাবা নিজে এসেছিলেন বড় জামাইয়ের কাছে। বলেছেন, সব দেখে-শুনে করে-কর্মে দিতে হবে, বলেছেন বাড়ির সকলেরই তো মাথা গরম কাজের কাজ কারো দ্বারা হবে না।
সব দেখে-শুনে করে-কর্মে দেবার জন্য যাবে, সুখেন্দু এমন কথা মুখে অবশ্য বলে নি। যায়ও নি। যাক, অর্চনাও মনে মনে চায় নি সেটা। মায়ের ভাবগতিক আর দাদার বড়লোকী কাণ্ডকারখানা জানে। এই লোকের এই মানসিক অবস্থায় আগের থেকে যাওয়া মানেই গোলযোগের সম্ভাবনায় পা বাড়ানো।
তা বলে বিয়ের রাতেও আসবে না এমন সংশয় অর্চনার মনে রেখাপাতও করে নি। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে দমেই যাচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে লোকজনের আনাগোনার দিকে সচকিত দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে।
কাঁচা ক্ষতর ওপর অতি নরম পালক বুলেলেও অসহ্য লাগে অনেক সময়। বড় জামাইয়ের খোঁজে ঘনিষ্ঠ অভ্যাগতদের স্বাভাবিক জিজ্ঞাসাবাদও বাড়ির মানুষদের সেই রকমই লেগেছে। ছোটখাটো উৎসব-অনুষ্ঠানে বা সামাজিক যোগাযোগে বড় জামাইটির সাক্ষাৎ কেউ বড় পায় নি বললেই চলে। অর্চনার বিয়ের পর অনেকেই হয়তো আর চোখেও দেখে নি তাকে। কাজেই এক বিয়েতে এসে ছোট জামাইয়ের প্রসঙ্গ থেকে বড় জামাইয়ের তত্ত্ব-তালাসটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেকে হয়তো কথায় কথায় নিছক সৌজন্যের খাতিরেই জিজ্ঞাসা করেছেন, বড় জামাই কোথায় বা বড় জামাইকে দেখলাম না! কিন্তু সেটুকুই বক্ত কৌতূহলের মত লেগেছে বাড়ির লোকেদের। বিজনের চাপ রোষ, মায়ের তার দ্বিগুণ, এমন কি বাবাও বিব্রত একটু।
সুস্থির বোধ করে নি অর্চনা নিজেও। একটু আগেই এক বান্ধবী সামনাসামনি চড়াও করেছিল ওকে, কি রে অর্চনা, তোর বরকে দেখছি না…কই?
অর্চনা হাসতে চেষ্টা করে ভ্রূকুটি করেছে–কেন, নিজেরটাতে পোষাচ্ছে না?
বান্ধবী অনুযোগ করেছে–থাক খুব হয়েছে, দু-বছর ধরে তো এমন আগলে আছিস যে একটা দিনও দেখলাম না ভদ্রলোককে।
অর্চনা বলেছে, তাহলে আর একটু ধৈর্য ধরে থা–এলেই দেখতে পাবি।
তখনো ধারণা, আসবে।
তার পর ইলা-মাসি জিজ্ঞাসা করেছে, ইলা-মাসির ছেলে মিন্টু খোঁজ করেছে, মাস্টার মশাই কোথায়?
নিচে এসেছিল বরুণার জন্যে এক গেলাস সরবত নিতে। বউদি এসে চুপি চুপি জানাল, এ বড় বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে…সবাই সুখেনবাবুর খোঁজ করছে, তোমার দাদা তোমাকে একবার টেলিফোন করতে বলছিল।
অর্চনা সরবত নিয়ে পাশ কাটাল। গম্ভীর মুখে বলে গেল, ইচ্ছে হয় তুমি কর গে–