ভাল। তুমি একলাটি বসে যে, বরুণা কই?
আছে ওদিকে কিছু একটা বলবেন বলেই যেন মেয়ের দিকে চেয়ে হাসতে লাগলেন তিনি। কিন্তু হাসিটা খুব প্রাঞ্জল মনে হল না অর্চনার।
কি মা?
ও-বাড়ি থেকে তোর পিসি-শাশুড়ী এসেছিলেন, তোরা বেরোবার একটু পরেই।
অর্চনা অবাক।–পিসিমা!!
হ্যাঁ। –আবারও মুখে হাসি টেনেই ডুয়ার খুলে একগোছ চাবি বার করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা তোকে দেবার জন্যে দিয়ে গেলেন–
নিজের অগোচরে চাবি হাতে নিল অর্চনা। বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত যেন। বাড়ির চাবি! বিমূঢ় মুখে বলল, চাবি …চাবি কেন?
উনি যে আজ বিকেলের গাড়িতেই হরিদ্বার যাচ্ছেন…
অর্চনা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু।
বিব্রত ভাবটুকু তল করে মিসেস বাসু বললেন, আদরযত্ন করতে গেলাম, এক গেলাস জলও মুখে তুললেন না, আমরা তো সব ম্লেচ্ছ কিনা–
অর্চনা অস্ফুট বাধা দিল–জল তিনি কোথাও খান না–কি বললেন?
বলবেন আবার কি, হুকুম করেই গেলেন, চাবিটা তোকে দিতে হবে আর আজই তোকে ও-বাড়ি চলে যেতে হবে–আজ কি করে যাওয়া হয় তোর?
অর্চনা অধীর মুখে বলে উঠল, কিন্তু উনি যাচ্ছেন কেন?
মেয়ের এত উতলা ভাবটা মনঃপূত নয় মিসেস বাসুর।–বুড়ো মানুষ, তীর্থ ধর্ম করে কাটাবেন, ভালই তো~-শুনলাম ওখানেই থেকে যাবেন।
অর্চনা চমকে তাকাল মায়ের দিকে। সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে। পরক্ষণে ছুটে বেরিয়ে সোজা এসে ঢুকল বাবার ঘরে। বাবা ঘরে নেই দেখে স্বস্তি বোধ করল একটু। তাড়াতাড়ি টেলিফোন তুলে ডায়েল করল।
টেলিফোন বেজেই চলল। সাড়া নেই।
টেলিফোন রেখে ত্রস্তে বেরিয়ে আসতেই মায়ের মুখোমুখি আবার।–মা গাড়িটা আছে তো?
আছে, কিন্তু তুই যাবি কোথায়?
জবাব না দিয়ে অর্চনা তার পাশ কাটিয়ে তরতরিয়ে নিচে নেমে এসে ড্রাইভারকে বলল গাড়ি বার করতে।
হাওড়া স্টেশন।
অর্চনা খবর নিয়ে জানল, হরিদ্বারের গাড়ি প্রায় চল্লিশ মিনিট আগে ছেড়ে গেছে।
শ্রান্ত অবসন্ন চরণে স্টেশন থেকে বেরিয়ে মোটরে উঠল। পরিত্যক্ত অনুভূতি একটা। জীবন থেকে এক নিশ্চিন্তনির্ভর বিচ্যুতির শূন্যতা।
কিন্তু– কেন? কেন? কেন? কেন?
অৰ্চনার কোনদিকে হুঁশ নেই। এই কেনটা আতিপাতি করে খুঁজে বার করতে চেষ্টা করছে। পিসিমা গেলেন কেন? আগে ওকে একটা খবর পর্যন্ত দিল না কেউ। কেন দিল না? অর্চনা ভাবছে। আসার আগের দিন আর আসার দিন পিসিমাকে একেবারে অন্যরকম দেখেছিল বটে। ওর দিক থেকেই যেন মুখ ফিরিয়ে ছিলেন তিনি। আসার দিন কিছু হয় নি, যা হয়েছে আগের দিনই। সেই দিনই রাত্রিতে খেতে বসে আর-একজনও জিজ্ঞাসা করেছিল, পিসিমার কি হয়েছে… কেন জিজ্ঞাসা করেছিল? কি দেখে?
ওই দিনটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখের সামনে দেখতে চেষ্টা করল।…শাশুড়ীর ছবি সরানো হয়েছিল, ছবিটা পড়ে ভেঙেছিল, পিসিমার ডাকাডাকি–ভাঙা ছবি দেখে তক্ষুনি বাঁধিয়ে আনার ব্যাকুলতা… চাকরটা হাত কেটে রক্তাক্ত…টেবিলে মায়ের টেলিফোন…
সহসা গাড়ির মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতই চমকে উঠল অর্চনা। অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ সহের অতিরিক্ত এক ঝলক আলো সরাসরি চোখে এসে পড়লে যেমন হয় তেমনি। মা পিসিমাকে কিছু বলেছিল টেলিফোনে… মা? অর্চনার সমস্ত মুখ সাদা পাংশু। প্রথম সাক্ষাতে ঘুরেফিরে মায়ের সেই জেরা…ও টেলিফোন ছেড়ে গিয়েছিল কেন…পিসিশাশুড়ী কেন ডেকেছিল কিছু বলেছে কিন…দুর্ব্যবহার করেছে কিনা… অর্চনা ভেবেছিল, নির্দেশমত ও সত্যিই চলে এলো দেখে মায়ের কৌতূহল। ওর নিজেরই ভিতরটা ভারাক্রান্ত তখন, মায়ের জেরায় তাই বিরক্তি বেড়েছিল।
এক সময় খেয়াল হতে দেখে গাড়ি বাপের বাড়ির রাস্তা ধরেছে। ড্রাইভারকে অস্ফুট নির্দেশ দিল অন্য ঠিকানায় যেতে।
গাড়ি থেকে নেমে অর্চনা দোতলার দিকে তাকাল। ঘরে আলো জ্বলছে। ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলে দিল।
দরজা খুলে সাবি ওকে দেখেই নিশ্চিন্ত।–তুমি এসেই গেছ বউদিমণি, বাঁচা গেল–
তার দিকে চেয়ে অর্চনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল একটু।–পিসিমা চলে গেলেন কেন সাবি?
ওমা, পিসিমা তো দুপুরে তোমার ওখান থেকেই এলেন, দেখা হয় নি?
অর্চনা মাথা নাড়ল।
সাবির কথায় কিছু বোঝা গেল না।–ক’দিনই থমথমে গম্ভীর দেখা গেছে তাঁকে, তারপর আজ চলে গেলেন।
অর্চনা পায়ে পায়ে ওপরে উঠে এলো।
টেবিলের ওপর ঝুঁকে সুখেন্দু লিখছে কিছু। অর্চনা কাছে এসে দাঁড়াল। সুখেন্দু মুখ তুলে একবার তাকে দেখে নিয়ে আবার লেখায় মন দিল। বিস্মিত হয় নি, বরং জানত যেন আসবে। ও-াড়ি গেছলেন, পিসিমা জানিয়েছেন। আর, বউমার সঙ্গে দেখা হল না সেই খেদও প্রকাশ করেছেন। লিখতে লিখতে ঠাণ্ডা প্রশ্ন করল, তুমি হঠাৎ…
পিসিমা চলে গেলেন কেন?
একটু থেমে মুখ না তুলেই জবাব দিল, আর থাকা সম্ভব হল না বলে।
কেন?
মুখ তুলে সুখেন্দু স্থির চোখে তাকাল। ওর ভিতরটাই দেখে নিতে চেষ্টা করল যেন। তারপর জবাব দিল, কেন সেটা আর তিনি মুখ ফুটে বলে যান নি।
আমাকে একটা খবর দিলে না কেন?
রুদ্ধ ক্ষোভ সংবরণ করে সুখেন্দ ফিরে জিজ্ঞাসা করল, খবর দিলে কি হত?
তিনি যেতে পারতেন না। কেন খবর দিলে না, এতটাই জব্দ করার জন্যে?
জব্দ কিসের, খুশীই তো হওয়ার কথা। প্রচ্ছন্ন উষ্মায় বিদ্রুপের আভাস।
তার মানে? অর্চনা নিস্পলক চেয়ে আছে।