আরো দেড় বছর কেটেছিল এইভাবে। তার পর সেই অঘটন।
ইস্কুলের পিছনেই গঙ্গার বাঁধানো ঘাট। বাইরের অনেকেই চান করে সেখানে। বিশেষ করে আশেপাশের খড়ো ঘরের মেয়ে-পুরুষেরা। দুপুরে টিফিনের সময় ইস্কুলের ছোট মেয়েদের খেলার আর বড় মেয়েদের বসার জায়গা ওই ঘাট।
ঘাটের দু-পাশের উঁচু উঁচু ধাপগুলোর ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠা-নামা করে ছোট মেয়েরা। শীতকালে জল অনেকটা নিচে থাকে। কিন্তু বর্ষায় ওই সিঁড়ির অর্ধেকটা তো ডোবেই, উঁচু ধাপগুলোরও দুদিক ছাপিয়ে জল উঠে আসে।
এই গেল-বর্ষায় এক দুপুরে ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘাটে চান করতে এসেছিল ভগবান তেওয়ারীর বউ সাবিত্রী।
রোজ দুপুরেই আসে। সেদিনও এসেছিল।
ছাপা শাড়ির আট হাত ঘোমটা টেনে পাকলে চান করাচ্ছিল লছমীকে। ছেলেটা নতুন সাঁতার শিখেছে, তাকে নাগালের মধ্যে পাওয়া ভার।
সেই দুপুরে বর্ষার ভরা গাঙের বিষম স্রোত আট বছরের ছেলেটাকে টেনে নিয়ে গেল।
তার মায়ের বুক-ফাটা কান্নায় আর চিৎকারে গোটা ইস্কুলটাই ভেঙে পড়ে ছিল এই ঘাটে। কোথা থেকে কত লোক জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঠিক নেই।
গণেশকে তোলা গিয়েছিল অনেক পরে। অনেক দূরে। নিষ্প্রাণ কচি দেহ আপনি ভেসে উঠেছিল।
এদিকে ঘাট থেকে নড়ানো যায়নি সাবিত্রীকে। ঘাটের ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদছিল।
তখন অনেকেই লক্ষ্য করেছিল, ওই শোকার্ত মায়ের দিকে চেয়ে দুই গাল বেয়ে নিঃশব্দে ধারা নেমেছে আর একজনেরও।
সেদিন আর ক্লাস নিতে পারেনি অর্চনা বসু।
তার পরদিন থেকে টিফিনের সময় তাকে আর সেই আমতলায় গিয়েও বসতে দেখেনি কেউ।
এর পর গঙ্গার দিকে যতবার চোখ গেছে ততবার যেন শিউরে শিউরে উঠেছে অর্চনা। বর্ষার লাল জলে শিশুদেহগ্রাসী লালসার বিভীষিকা দেখেছে।
…মেয়েরা দৌড়োদৌড়ি করে, ছুটোছুটি করে ওই ধাপগুলোর ওপর। ফসকে বা টাল সামলাতে না পেরে একবার ও-পাশে পড়লে–
আতঙ্কে অস্থির হয়ে অর্চনা দৌড়ে গেছে হেডমিসট্রেসের কাছে। টিফিনে মেয়েদের ঘাটে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। বড় মেয়েরা গেলে ছোট মেয়েরাও যাবে –সেটা অত্যন্ত ভয়ের কথা।
হেডমিসট্রেস অবাক। বলেন, কিন্তু ওই মালীর ছেলেটা তো চান করতে গিয়ে ডুবেছে। মেয়েদের আটকাব কেন?
ভয়ের কি আছে আর কেন আটকানো দরকার অর্চনা বুঝিয়ে দেয়। তার সেই বোঝানোর আকূতি দেখে মনে হবে, যেন আর একটি ছোট মেয়েকেই বোঝাচ্ছে সে।
হেডমিসট্রেস চুপচাপ তার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন খানিক। পরে বলেন, আচ্ছা, আমি তাদের সাবধান করে দেব।
কিছু বলার জন্যেই বলা। নইলে কিছুই তিনি করবেন না জানা কথা। উদার মত-পন্থিনী প্রধান শিক্ষয়িত্রী কোন কল্পিত ভয়ে মেয়েদের স্বাধীনতা খর্ব করতে রাজী নন।
কিন্তু অর্চনা বসুর চোখে এ ভয়টা ভয়ই।
কাজেই, যা করবার নিজেই করতে বসল। একদিন দুদিনে কাজ হল না, কিন্তু চার পাঁচ দিনের মধ্যে হল। অৰ্চনা বসু তো মাস্টারি করে বাধা দিতে যায়নি কোন মেয়েকে। তার নিষেধের মধ্যে অব্যক্ত অনুনয়টুকুই বাধা হয়ে উঠেছিল বড় মেয়েদের কাছে। অবশ্য একবারেই ঘাটের মায়া ছাড়িয়ে উঠতে পারেনি তারা। কিন্তু অর্চনাদির চোখে চোখ পড়তে কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেছে। অনুযোগভরা ওই ঠাণ্ডা দু-চোখের অস্বস্তি তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ঘাটে আসা ছেড়েছে আর নিচু ক্লাসের ছোট মেয়েদেরও আগলে রেখেছে। ফলে টিফিনের সময় ঘাট খাঁ খাঁ করে এখন।
মেয়েরা জেনেছে অর্চনাদির জলের ভয় খুব। কিন্তু সহশিক্ষয়িত্রীরা মুখ টিপে হেসেছে। কানে কানে ফিসফিস করেছে মীরাদি আর প্রভাদি, প্রতিভাদি আর শোভাদি। বিজ্ঞানের টিচার আর মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী শোভা ধর তার মত বদলেছেন একটু। রোগ ঠিকই, কিন্তু যে রোগ ভেবেছিলেন সে-রোগ নয়। ভগবান তেওয়ারীর ওই কচি ছেলেটা জলে ডোবায় কয়েকদিনের মধ্যেই মত বদলাবার মত কারণ কিছু ঘটেছিল। অর্চনা বসুর এই বাৎসল্যজনিত আতঙ্কের পিছনে অন্য কিছু আভাস পেয়েছেন সকলেই।
বিস্ময়কর কিছুর।
২. অর্চনা বসু
০২.
বড় নির্মমভাবে ধরা পড়েছে অর্চনা বসু।
এক ডানা-ভাঙা পাখি যেন ধরা পড়েছে একদল দুরন্ত অবুঝের হাতে।
এত কাছে থেকেও একদিন যাঁরা তাঁর হদিস পাননি, দিগন্ত-ঘেঁষা নীলিমার ব্যবধান কল্পনা করেছেন ঈর্ষাতুর সম্ভ্রমে–হঠাৎ এই আবিষ্কারের বিস্ময় তাঁদের আনন্দের কারণ হবে বইকি। তাঁদের প্রগলভ কৌতূহলে একটা দুমড়নো ব্যথা খচখচিয়ে উঠলেও মৌন যাতনায় সেটা সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। ডানা-ভাঙা পাখির মতই মুখ বুজে একপাশে সরে থাকতে চেয়েছে অর্চনা বসু। সরে থাকতে চাইছে।
মনের নিভৃতে অতলে সারাক্ষণ আলেয়ার যে আলো জ্বলে তারই মায়ায় নিজেকে উদঘাটিত করে ফেলেছিল।
করে ধরা পড়েছিল।
কিন্তু সে-মায়ার প্রলোভন একদিনের নয়। গোপন প্রশ্রয়ে দিনে দিনে বুকের কাছটিতে এসে জমেছিল। ইশারায় বিভ্রান্ত করেছিল। এখানে আসার পরেও একটানা প্রায় দু-বছর যুঝেছিল অর্চনা বসু। দু-বছরের প্রত্যেকটা দিন।
আর এই দু-বছর ধরেই তার আত্মমগ্নতার একটা প্রচ্ছন্ন দম্ভ দেখে এসেছেন অন্য সকলে। সেই প্রথম যেদিন অর্চনা বসু পা দেয় এই মেয়ে-ইস্কুলে সে-দিন থেকেই।
এই দু-বছরের চিত্রটি আগে আর একটু স্পষ্ট হওয়া দরকার।
সেও ছিল এক ভরা দুর্যোগের দিন।