সুখেন্দু নিরুত্তরে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। আরো কিছু বক্তব্য আছে অনুমান কবেই শেষে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?
জবাবে খুব সাদাসিধে ভাবেই যে সঙ্কল্পটি ব্যক্ত করলেন, শুনে নির্বাক কিছুক্ষণ। আগামী পরশু তিনি হরিদ্বার যাচ্ছেন জায়ের কাছে। জা কতকাল ধরে লেখালেখি করছেন যাবার জন্যে, কিন্তু হয়ে আর ওঠে না। এবারে মনস্থ করেছেন যাবেন। হরিদ্বারে চিঠি লিখে জানানোও হয়ে গেছে। যাবার সঙ্গীও জুটে গেছে, তার গুরুদেব-বাড়ির আরো কারা যাচ্ছে সেদিন। তাই বউমাকে কালই গিয়ে ওর নিয়ে আসা দরকার।
যত সহজ ভাবেই ইচ্ছাটা ব্যক্ত করুন তিনি, শোনা মাত্র সুখেন্দুর মনে গভীর একটা আঁচড় পড়ল। স্থির দৃষ্টি তার মুখের ওপর সংবদ্ধ।…সেজন্যে তোমার যাওয়া আটকাবে না।…কবে ফিরবে?
জবাব দিতে গিয়ে বিব্রত বোধ করছেন, দৃষ্টি এড়াল না। বললেন, আমি আপাতত ওখানেই থাকব ঠিক করেছি রে।আরো সহজ ভাবে প্রসঙ্গ নিষ্পত্তির চেষ্টা করলেন তিনি-ক’বছর আগেই তো যাব ঠিক ছিল, তোর মায়ের জন্য পণ্ড এবারে আর আটকাস না বাবা।
সুখেন্দু চেয়েই আছে। দেখছে। চেয়ার ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকাল একবার। টেবিলের কাছে এসে অন্যমনস্কের মত একটা বই নাড়াচাড়া করল। তারপর ক্ষুদ্র জবাব দিল, আচ্ছা।
পিসিমা যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়ালেন। দেখলেন একটু।–হ্যাঁ রে, রাগ করলি?
সুখেন্দু মাথা নাড়ল, রাগ করে নি। তারপর শান্ত মুখে বলল, তুমি এখানে। থাকতে পারবে না আমি আগেই জানতুম পিসিমা, কিন্তু সে-যে এত শিগগির, ভাবি নি।
হাতের বইটা ফেলে পিসিমার খুব কাছে এসে দাঁড়াল সে। কণ্ঠস্বর বদলে গেল।–পিসিমা, কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?
স্পষ্ট বিড়ম্বনা–এই দ্যাখো… আমাকে আবার কে কি বলবে।
পিসিমার বাহুতে একখানা হাত রাখল, সুখেন্দু। আবার জিজ্ঞাসা করল, কেউ বলেছে কিছু?
অর্থাৎ এবারে সে গা ছুঁয়ে জিজ্ঞাসা করছে, সত্যি না বললে ওরই অকল্যাণ। পিসিমার এই দুর্বলতা সুখেন্দুর জানা আছে। জবাব শোনারও আর দরকার ছিল না, তাঁর বিব্রত মুখভাবেই জবাব লেখা।
পিসিমা জোর দিয়েই বললেন, না রে না, যা ভাবছিস তা নয়, বউমা আমাকে কোনদিন এতটুকু অশ্রদ্ধা করে নি।
সুখেন্দু তাঁর বাহু থেকে হাত নামাল না তবু। স্থির নিস্পলক চেয়ে আছে।–বউমা ছাড়াও অশ্রদ্ধা করার লোক আছে, তার মা বা আর কেউ কিছু বলেছে?
ধরা পড়ে পিসিমা ফাঁপরে পড়ে গেলেন একেবারে। নিরুপায় মুখে রাগ দেখালেন, পাগলামো করিস নে, আর কারো কথায় আমার কি আসে যায় বউমাকে কালই গিয়ে নিয়ে আয়, বলবি আমি ডেকেছি।
সুখেন্দু হাত নামিয়ে নিল। যেটুকু বোঝার বুঝে নিয়েছে। আঘাতটা কোথা থেকে এসেছে অনুমান করতে পেরেছে। চুপচাপ চেয়ারে এসে বসল আবার।
তার মুখের দিকে চেয়েই পিসিম নির্বাক খানিকক্ষণ। যা গোপন করে নিঃশব্দে চলে যেতে চেয়েছিলেন সেটা যেন উল্টে আরো বেশিই স্পষ্ট হয়ে গেল। গেল বলেই সমস্ত মুখে ব্যথার ছাপ দু’চোখ ভরে জল আসার উপক্রম। সামলে নিয়ে আর একটু কাছে এলেন। স্পষ্ট কোমল সুরে বললেন–দ্যাখ, তোকে একটা কথা বলব–
কঠিন গাম্ভীর্যে সুখেন্দু চোখ তুলে তাকাল শুধু।
বউমা খু-ব লক্ষ্মী মেয়ে, আমার চোখ অত ভুল করে না। তাকে তুই কক্ষনো দুঃখ দিস নে–
চোখের জল সংবরণ করে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পরদিন সকাল দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়াতে চলল। বউমাকে কোন খবর দেওয়া হয় নি বা হবে না সেটা তিনি আগেই অনুমান করেছেন। একবার ঠিক করলেন, নিজেই টেলিফোনে ডাকরেন তাকে। আবার ভাবলেন, হরিয়াকে পাঠিয়ে খবর দেবেন। সে বাড়ি চেনে। শেষে কি ভেবে কিছুই করলেন না। তার পরদিনও গোছগাছ করতে করতে সকাল কেটে গেল। সেই দিনই বিকেলে গাড়ি। সুখেন্দু কলেজে যাবার আগে বলে গেছে, সে-ই এসে সময় মত স্টেশনে পৌঁছে দেবে। গোছগাছের ফাঁকে ফাঁকে পিসিমা হরিয়া আর সাবিকে বাবতীয় খুঁটিনাটি নির্দেশ দিলেন! আর হরিয়াকে বলে রাখলেন, সে যেন চলে না যায়, কাজ আছে।
দ্বিপ্রহরের মধ্যে সব সেরে রেখে চাবির গোছা আঁচলে বেঁধে হরিয়াকে ডাকলেন, আয় আমার সঙ্গে।
.
এই কটা দিন খানিকটা হৈ-চৈএর ওপরেই কাটিয়েছে অনা। ভিতরের তাপ একটুও বুঝতে দেয় নি। বরুণাকে আলটেছে, বউদির নভেল পড়া নিয়ে খুনসুটি করেছে, বাবার তত্ত্ব-বিশ্লেষণ শুনেছে আগের মতই, সেজেগুজে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে কেনা-কাটাও করেছে। আর এই করে মনের দিক থেকে হালকাও হয়েছে অনেকটা। নিরিবিলিতে বাড়ির কথা বেশি মনে হয় বলেই নিরিবিলি চায় না। তা সত্ত্বেও টেলিফোনে পিসিমার সঙ্গে কথা বলতে লোভ হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু অভিমানটা এবারে তার ওপরেই বেশি–একদিন টেলিফোন তুলেও আবার রেখে দিয়েছে।
সেদিন দুপুরের শো-এ দাদা-বউদির সঙ্গে কি একটা ছবি দেখতে গিয়েছিল। বলা বাহুল্য, ননিমাধবও ছিল এবং তার আগ্রহেই যাওয়া।
ফিরেও ছিল খুশী মনেই।
ওপরে নিজেদের ঘরে ঢুকে বরুণাকে দেখবে আশা করেছিল। ওকে কলেজে পাঠিয়ে নিজেরা কত ভাল ছবি দেখে এলো একটা, সেই সমাচার শুনিয়ে ওকে রাগাবার ইচ্ছে ছিল।
বরুণার বদলে মা বসে তাদের ঘরে।
কিছু একটা ভাবছিলেন, অর্চনার সাড়া পেয়েই চকিতে হাসি টেনে আনলেন মুখে।কেমন দেখলি?