চলে এলো। বই ফেলে সুখেন্দু গুম হয়ে চেয়ারে এসে বসল আবার। একবার ইচ্ছে হল তক্ষুনি ডেকে বলে দেয়, কোথাও যাওয়া হবে না। কিন্তু সেটা বলার মতও কোথাও যেন জোরের অভাব। অর্চনা হয়তো মুখের দিকে চেয়ে থেকেই হাসবে আবার আর বলবে, আচ্ছা যাব না।
বাধা দেবার মত জোরালো অথচ নিস্পৃহতর একটা উপলক্ষ মনে পড়ে গেল।…পিসিমা কি মনে করবে? পিসিমা দুঃখ পেতে পারে তেমন কারো ছেলেমানুষিই সে বরদাস্ত করবে না। তক্ষুনি উঠে পাশের ঘরে এসে দেখে অর্চনা নেই। বারান্দায় নেই। বোধহয় নিচে। ঝোঁকের মাথায় সামনে পেলে বলে ফেলত। না পেয়ে ভাবল পরে বলবে।
বারান্দায় পায়চারি করল দুই-একবার। পিসিমার পূজোর ঘরের দিকে চোখ পড়তে অবাক একটু। এ-সময়টা ও-ঘর অন্ধকার থাকে না বড়। পায়ে পায়ে সেই দিকে এগুলো। এমনিই। পাশে পিসিমার শোবার ঘরেরও আলো নেবানো। ফিরে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। মনে হল, কোণের দিকে মেঝেতে কেউ বসে। ঘরে ঢুকে আলো জ্বলল।
পিসিমাই। দেয়ালে ঠেস দিয়ে নিঃশব্দে বসে ছিলেন। দুই চোখে জলের ধারা। বিষম চমকে উঠে তাড়াতাড়ি আঁচলে করে চোখ মুছতে লাগলেন তিনি।
সুখেন্দু নির্বাক খনিকক্ষণ।– কি হয়েছে?
কিছু না, এমনি বসে ছিলাম।…এই অবস্থায় তাকে দেখে ফেলাটা সামলে নিয়ে সহজ হতে চেষ্টা করলেন।–তুই কখন এলি, খেতে-টেতে দিয়েছে?
সুখেন্দু কাছে এগিয়ে এলো। আবারও নিরীক্ষণ করে দেখল।–কি হয়েছে?
কিছু না রে বাবা, ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন–কত সময় কত কি মনে পড়ে– যাই রাত হয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি ঠাকুরঘরের দিকে পা বাড়ালেন। চুপচাপ আরো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সুখেন্দু নিজের ঘরে চলে এলো। একটু বাদে বইখাতা নিয়ে ছেলে পড়াতে চলে গেল। পিসিমাকে ওভাবে দেখে হঠাৎ ধাক্কাই খেয়েছে একটা। কিছু ভাবতে পারছে না।
সেই রাতেই অর্চনা পিসিমার কাছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাপের বাড়ি গিয়ে কিছুদিন থাকার প্রস্তাবটা উত্থাপন করল। আগে বোনের বিয়ের খবর জানাল, তারপর বলল, মা কিছুদিন গিয়ে থাকার জন্যে বার বার করে বলেছেন–
পিসিমার শুকনো উত্তর, আমাকে বলার কি আছে, সুখেনকে বলো–
এভাবে কথা বলতে অর্চনা শোনে নি কখনো। বোনের বিয়ে শুনেও একটা কথা জিজ্ঞাসা করলেন না সেটা আরো অপ্রত্যাশিত। তবু নিজে থেকেই অর্চনা বোনের বিয়ের প্রসঙ্গে এটা-সেটা জানাল। কিন্তু কোন সাড়া পেল না বা আগ্রহ দেখল না। উল্টে কেমন একটা রুক্ষ নীরবতাই লক্ষ্য করল। এই প্রথম অর্চনা মনে মনে বেশ ক্ষুণ্ণ হল তার ওপরেও।…বাড়ির ছেলেটি তুষ্ট না থাকলে ও কেউ নয়, এই আচরণে পিসিমা সেটাই স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন বোধহয়।
রাত্রিতে খাবার টেবিলে বসে সুখেন্দু নিজে থেকে কথা বড় বলেই না। আজকাল। খেয়ে চুপচাপ উঠে চলে যায়। এক একদিন অর্চনা সঙ্গে না বসেও দেখেছে, তাও কিছু জিজ্ঞাসা করে নি। কিন্তু সেই রাত্রিতে খেতে বসে ভাতে হাত দেবার আগেই ওর দিকে তাকাল! কিছু যেন নিরীক্ষণ করছে। অর্চনা ফিরে তাকাতে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করল, পিসিমার কি হয়েছে?
অর্চনা মনে মনে অবাক; এরকম প্রশ্ন কখনো শোনে নি।–-কি হবে?
জানো কি না জিজ্ঞাসা করছিলাম।
জিজ্ঞাসাটা জেরার মত লেগেছে অর্চনার। নিরুত্তাপ জবাব দিল, তোমাদের এখানে কার কখন কি হয় এই দু-বছরেও ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি।
খেতে খেতে সুখেন্দু তেমন ঠাণ্ডা গলায় বলল, পারলে ভাল হত।
অর্চনা চেষ্টা করল হাসতে, তার এবারের উক্তিটা বিদ্রুপের মতই শোনাল। কি আর করবে বলো, তোমাদের বরাত মন্দ …কি ভাবে বুঝতে হবে বলে দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারি–
পরদিন যাবার আগে পিসিমাকে প্রণাম করার সময়ও একটি কথা বললেন না তিনি। ক’দিন থাকবে বা কবে ফিরবে, কিছু না। পিঠে হাত রেখে শুধু নির্বাক আশীর্বাদ করলেন একটু। সুখেন্দু বাড়ি নেই, সকালের টুইশনে বেরিয়েছে। তার ফেরার সময় হয়ে গেছে। ফেরে নি।
অর্চনা নীরব অভিমানে বাপের বাড়ি চলে গেল।
.
পাঁচ-ছ দিনের একটানা গাম্ভীর্যের পর পিসিমাকে প্রায় আগেই মতই সহজ হতে দেখা গেল সেদিন। সকালে সাবি রাধুনী অগোছালো কাজের দরুন বকুনি খেয়ে নিশ্চিন্ত, হরিয়া চাকরও হুকুম তামিল করে হালকা একটু। এই ক’দিনের মধ্যে সেদিন রাতেই বউয়ের ঘরটা অন্ধকার দেখে নিজেই ভিতরে এসে আলো জেলে দিলেন। শূন্য ঘরটার চারদিকে চেয়ে কেমন শূন্যতাও বোধ করলেন তিনি। দেয়ালের গায়ে ঠিক আগের জায়গায় সুখেনের মায়ের ছবিটা টাঙানো দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন! অর্চনা চলে যাবার পর সুখেন্দু নিজের হাতে এটা আবার এখানেই টাঙিয়ে রেখেছিল।
ভিতরের দরজা দিয়ে পিসিমা পাশের ঘরে এসে দাঁড়ালেন। সুখেন্দু ঈজিচেয়ারে বসেছিল। এ ঘরে আলো জ্বলতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে এদিকেই তাকিয়েছিল সে। পিসিমা বললেন–এ ঘরটা অন্ধকার করে রাখিস কেন,মেয়েটা না থাকলে এমনিতেই বর খাঁ খাঁ করে।
ব্যতিক্রম দেখে সুখেন্দুও বোধ হয় হালকা নিবাস ফেলল। পিসিমা সামনে এসে দাঁড়ালেন। হ্যাঁ রে, বউমা ফিরছে কবে?
সুখেন্দু অবাক একটু।–কিছুদিন তো সেখানে থাকবে শুনেছিলাম…তোমাকে বলে যায় নি?
পিসিমা জবাব দিলেন, বলেছে হয়তো…আমারই খেয়াল নেই। যাক তুই কালই গিয়ে নিয়ে আয় তাকে, আর যে-দুটো বাড়িতে আছে তাদের তো খাস জ্ঞান গম্যি–সময়মত হয়তো একটু ধূপধুনোও পড়বে না।