এগিয়ে এসে অর্চনা ছবিটা তুলল। কাচ নয় শুধু, ফ্রেমও ভেঙেছে। জায়গায় জায়গার কাচ বিঁধে আছে। মূর্তিটি অক্ষত আছে এই যা। বলল, না ছবি ঠিক আছে।
সুখেন কলেজ থেকে ফেরবার আগে ওটা বাঁধিয়ে আনার ব্যবস্থা করো। …সখেদে হরিয়াকে তাড়া দিলেন তিনি, এই জংলি, ওগুলো রেখে ছবি নিয়ে আগে দোকানে যা শিগগির
ঘাবড়ে গিয়ে হরিয়া কাচ কুড়ানো ছেড়ে তাড়াতাড়ি ফোটো নেবার জন্য হাত বাড়াতে অর্চনা দেখে তার হাত কেটে রক্তাক্ত।–আবার হাতও কেচ্ছে, দেখি–ইস!
বেশিই কেটেছে মনে হল। সমস্ত হাত রক্তে মাখা। ছবিটা অর্চনা দেয়ালের এক ধারে সরিয়ে রেখে হরিয়াকে নিয়ে বাইরে এলো। তার হাতে জল ঢেলে দিতে দিতে ঘরে আয়োডিন-তুলো আছে কিনা ভাবতে গিয়ে কি মনে পড়ল।…মা টেলিফোন ধরে আছেন। মুখ তুলে দেখে পিসিমা তখনো দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে। বলল, পিসিমা, মা টেলিফোনে রয়েছেন, আপনি একটু বলে দিন না আমি পরে টেলিফোন করব’খন।
অর্চনা হরিয়ার হাত দেখায় মন দিল আবার, ক’জায়গায় কেটেছে ঠিক নেই।
টেলিফোন কানে লাগিয়ে পলে পলে জ্বলছিলেন মিসেস বাসু। যে মেয়ের জন্য এত ভাবনা তার, সে-ই যদি এমন হয় তিনি পাবেন কি করে। ভাক শুনেই অন্তে এ-ভাবে টেলিফোন ফেলে চলে যাওয়াটা অসহ তার কাছে। আর গেছে তো গেছেই। এমন নিরীহ বশ্যতার দরুন মেয়ের ওপরেই মর্মান্তিক ক্রুদ্ধ। ওদিক থেকে টেলিফোন তোলা বা ভাল করে সাড়া পাওয়ার আগেই সপ্তকণ্ঠে ছিটকে উঠলেন তিনি।–দ্যাখ, এখনো নিজের ভাল বুঝতে শেখ,–উঠতে পিসিমা বসতে পিসিমা–টেলিফোনে কথা কইছিল, তাও পিসিমা–তোর হল কি?
এদিকের মহিলাটি হঠাৎ যেন হকচকিয়ে গেলেন একেবারে। নিজের অগোচরে সাড়া দিতে গেলেন, আমি–
আমি-আমি অনেক শুনেছি।…রাগের মাথায় মিসেস বাসু ভাবতেও পারেন না কি অঘটন ঘটাতে বসেছেন! রূঢ় কণ্ঠেই ঝাঁকিয়ে উঠলেন তিনি-অনাথা, বিধবা মানুষ বাড়িতে আছে থাক, তা বলে তার এত কর্তৃত্ব কিসের? আর তোদেই বা তাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? তুই এখানে এসে থাকবি দু-মাস তাকে বলেছিস?
সাড়া নেই। আচমকা আঘাতে পিসিমা একেবারে বিমূঢ়।
মেয়ে ঘাবড়ে গেছে ভেবে মিসেস বানুর অসহিষ্ণু নির্দেশ, তোর ভয়টা কিসের? পষ্ট জানিয়ে দিবি আমি বলেছি তুই এখানে এসে থাকবি দু’মাস। না পারিস আমিই সুখেনকে বলব–
আরো দুই-এক মুহূর্ত পাথরের মত দাঁড়িয়ে থেকে পিসিমা এবারে সাড়া দিলেন। শান্ত গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি পুখেন্দুর পিসিমা…বউমা আপনাকে পরে টেলিফোন করবেন জানিয়েছেন।
রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। পাংশু, বিবর্ণ সমস্ত মুখ। খেয়াল হতে দেখেন সাবি অবাক চোখে তাকেই দেখছে। সে ওপরে আসতে বউদিমণি তাকে ঘর থেকে আয়োডিন-তুলে এনে দিতে বলেছিল। তাঁর টেলিফোনের কথাগুলো নয়, মূখের এই ভাবান্তরটুকুই সাবির বিস্ময়ের কারণ।
কি চাস?
আয়োডিন-তুলো–
নিয়ে যা।…তার পাশ কাটিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অদূরে ও-দিক ফিরে অর্চনা হরিয়ার হাত উল্টে-পাল্টে দেখছে। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে এসে অনুভূতিশূন্য মূর্তির মত বসে রইলেন তিনি।
হরিয়ার হাতের ব্যবস্থা করে অর্চনা ফিরে এসে ঘর পরিষ্কার করল। তার পর কি ভেবে শাশুড়ীর ছবিটা নিজেই বেরিয়ে ছবি-বাঁধাইয়ের দোকানে দিয়ে এলো। সন্ধ্যার আগে আবার গিয়ে নিয়েও এলো। এ-বেলা হরিয়া আসেই নি। সদ্য-বাধানো ছবি অর্চনা পাশের ঘরে সুখেন্দুর টেবিলের ওপরেই রেখে দিল।
পিসিমার সামনা-সামনি বার-কতক এসেছে। নিজের ভিতরটা সুস্থির থাকলে তার স্তব্ধতা অস্বাভাবিক লাগত। যেটুকু চোখে পড়েছে, ভেবেছে, ছবিটা ওভাবে ভেঙেছে বলে মন খারাপ, আর ওদের ব্যাপারটা অনুমান করেই কিছুটা গম্ভীর এবং অপ্রসন্ন।
বাড়ি ফিরে মায়ের ছবি টেবিলের ওপর দেখে সুখেন্দু প্রথমেই হরিয়ার উদ্দেশে হাঁক দিল। তার পর সদ্য পালিশ করা নতুন ফ্রেম নজরে পড়তে সেটা হাতে তুলে নিল। হরিয়ার বদলে জলখাবার হাতে অর্চনা ঘরে ঢুকেছে।–হরিয়া এ-বেলা আসে নি, জ্বর হয়ে থাকতে পারে, হাত অনেকটা কেটেছে। ছবি টাঙাতে গিয়ে ফেলে ভেঙেছিল, কাল আসে তো আবার চেষ্টা করা যাবে।
এই ফ্রেম আগে যা ছিল তার থেকে সুন্দর তো বটেই, দামীও। পছন্দটা হরিয়ার নয় বুঝেছে। ছবিটা টেবিলে রেখে সুখেন্দু, চুপচাপ হাতমুখ ধুয়ে এলো। অর্চনা নিঃশকে অপেক্ষা করছিল, তার খাওয়া শেষ হতে বলল–কাল আমি মায়ের ওখানে যাচ্ছি, কিছুদিন সেইখানেই থাকব ঠিক করেছি।
বলার সঙ্গে সঙ্গে ওদিকের প্রচ্ছন্ন অসহিষ্ণুতা উপলব্ধি করা গেল। সুখেন্দু উঠে টেবিলের একটা দরকারী বই-ই যেন উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল।–পিসিমাকে বলে যাও।
তোমাকে বলার দরকার নেই?
ঠিক করে ফেলার পর আর না বললেও চলে।
অর্চনা চুপচাপ দেখল দেখল একটু।–-ঠিক আজই করেছি…ঘর থেকে তোমার মায়ের ছবি সরানোর পর। তখন তুমি ছিলে না।
সুখেন্দু চকিতে তাকাল একবার। আঘাতের বিনিময়ে ক্ষোভ অথবা সমর্পণটাই হয়তো স্বাভাবিক প্রত্যাশা। অন্যথায় ফল বিপরীত। সশ্লেষে জিজ্ঞাসা করল, আপাতত তাহলে বেশ কিছুদিনই সেখানে থাকবে?
তার দিকে চোখ রেখেই অর্চনা হাসল একটু, তার পর খুব সহজ ভাবেই জবাব দিল, কি করে বলি…আমার এখানে থাকাটা তেমন অসহ হবে না বুঝলে আগেই না-হয় গিয়ে নিয়ে এসো।