অশুভ সূচনাই।
জীবনের পাশায় মায়ের দানগুলো বড় নিখুঁত ভাবে পড়ে।
টেলিফোন বাজল। অর্চনা উঠে এসে টেলিফোন ধরল। মায়ের টেলিফোন।
এক জায়গায় বরুণার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল কিছুদিন ধরে। অর্চনা শুনেছিল, ছেলের বাড়ির মস্ত অবস্থা নিজেদের বাড়ি-গাড়ি, ছেলেও বড় চাকরি করে। কোন একটা পার্টিতে ছেলের এবং ছেলের বাড়ির সকলের সঙ্গে মায়ের পরিচয়। অর্চনার বিয়ের পর থেকেই মায়ের সঙ্গিনী বরুণা। বড় মেয়ের বেলায় যা তিনি পারেন নি, ছোট মেয়ের বেলায় সেটা পেরেছেন। মনোমত যোগাযোগ একটা ঘটেছে শেষ পর্যন্ত। মায়ের ছেলে পছন্দ হয়েছে, অপর পক্ষের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। অবশ্য বরুণা অপছন্দের মেয়ে নয়। আর ছেলের তরফের পছন্দটা আরো জোরালো করে তুলতে হলে মেয়ে ছাড়াও আনুষঙ্গিক আর যা দরকার বিজন দরাজ অন্তঃকরণে তার সবটা ভার নিয়েছে। খরচপত্র যা লাগে লাগুক, ভাল বিয়ে হোক একটা–।
সেই বিয়ের কথাবার্তা পাকা এতদিনে।
টেলিফোনে মিসেস বাসু বড় মেয়েকে সেই সংবাদ দিলেন।
অর্চনা যথার্থ খুশী। এমন কি ক্ষণকাল আগের গুরুভারও অনেকটা হালকা হয়ে গেল। সানন্দে বলল, খুব ভাল মা, খুব ভাল হল।
ভাল যে হল সেটা মা খুব ভাল করেই জানেন। কিন্তু বড় মেয়ের ব্যাপারে সেই ভাল না হওয়ার খেদ তাঁর দিনে দিনে বেড়েছে বই একটুও কমে নি। ফলে এই মেয়ের জন্যেই তাঁর দুশ্চিন্তা আর দরদ বেশি। অথচ কিছুকাল ধরে তিনিও অনুভব করেছেন, মেয়ের নিরঙ্কুশ ভবিষ্যৎ-রচনা সব চেষ্টাই তাঁর ব্যর্থ। শুধু তাই নয়, মেয়েও যেন মনে মনে বিরাগ তাঁর ওপর। বিজ্ঞানের জন্মদিনে সেটুকু স্পষ্টই উপলব্ধি করেছেন তিনি। মেয়ে অবুঝ, মেয়ের এই মনোভাব তিনি গায়ে মাখেন না অবশ্য। কিন্তু সেটাও দুর্ভাবনার কারণ তো বটেই। ওকে সুদ্ধু বিগড়ে দিলে আশার আর থাকল কি? সেই কারণে জামাইয়ের ওপর সম্প্রতি আরো বেশি বিরূপ তিনি। শুধু জামাইয়ের ওপর নয়, এ-বাড়ির আর এক নির্বিরোধী মহিলার ওপরেও। অযাচিত অবাঞ্ছিত ভাবে যিনি মেয়ের সংসারটিকে আগলে আছেন বলে তার বিশ্বাস, আগলে থেকে মেয়ের সামান্য ভবিষ্যৎটুকুও ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছেন।
সম্প্রতি মেয়ের অশান্তির একটু-আধটু আভাস তিনিও পাচ্ছেন। আগের মত আর তেমন হৈ-চৈ করে না, তেমন খোলা-মেল হাসে না। আসেও না বড়। দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় মিসেস বাসু মনে মনে অস্থির। তাই বরুণার বিয়ে উপলক্ষ করে শক্ত হাতে আর একবার হাল ধরবেন মনস্থ করেছেন। মেয়েকে কিছুকাল এখানে আটকে রেখে জামাইয়ের সঙ্গে পষ্টাপষ্টি ফয়সালা করে নেবেন একটা। তাঁর কাছে থাকলে মেয়ের আলগা ভয়-ভাবনা সঙ্কোচও কাটবে কিছুটা।
তাঁর টেলিফোন শুধু বরুণার বিয়ের খবর জানার উদ্দেশ্যেই নয়।
কিন্তু সংকল্পটা আপাতত ঘুরিয়ে ব্যক্ত করলেন তিনি। প্রথমেই জেনে নিলেন সুখেন্দু ঘরে আছে কি না। তার পর প্রস্তাব করলেন, আসছে রবিবার বিজন আর বউমা ছেলের বাড়ি যাচ্ছে আলাপ-পরিচয় করতে, অর্চনাকেও যেতে হবে। অতএব কালই যেন সে চলে আসে, শুধু তাই নয়, এবারে এসে মাস দুই তাকে থাকতে হবে-নইলে বাড়িটা একেবারে খা খা করবে।
অর্চনা রবিবারে ছেলের বাড়ি যেতে রাজী, কিন্তু দ্বিতীয় প্রস্তাবে তার আপত্তি। বলল, অতদিন থাকব কি করে মা…
টেলিফোনের ওপার থেকে মায়ের বিরক্তি।–কেন, অসুবিধেটা কিসের, বিয়ের এই দু-বছরের মধ্যে একসঙ্গে দশটা দিনও এসে থেকেছিস? বিয়ে হয়েছে বলে কি মাথা কিনেছে নাকি তারা?
তাঁর দিক থেকে বড় সুসময়ে বলেছেন কথা ক’টা। এখানকার এই আবহাওয়া অর্চনাও বরদাস্ত করে উঠতে পারছিল না। আজকের গ্লানি আরো দুর্বহ।…দিনকতকের জন্য সরে গেলে মন্দ হয় না। ফোটো আপনিই আবার এ-ঘরে এনে টাঙাতে বাধ্য হয় কি না দেখা যেতে পারে। বিয়ে হয়েছে বলে সত্যিই তো মাখা বিকোয় নি। মেজাজের মাত্ৰাজ্ঞান নেই যখন মেজাজ নিয়েই থাকুক কিছুদিন।
অন্যমনঙ্কের মত বলল, আচ্ছা, পিসিমাকে বলে দেখি–।
পিসিমাকে আবার বলবি কি। মায়ের কণ্ঠস্বর চড়ে গেল, সুখেন্দুকে বলে সোজা চলে আসবি, বলবি আমি বলেছি।
আ-হা, তুমি বুঝছ না–
সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘরে উঁচু থেকে কিছু একটা পড়া এবং ঝন ঝন ভাঙার শব্দ। অর্চনা চমকে তাকাল। রিসিভার কান থেকে সরে গেছে, মায়ের কথা কানে গেল না। ওধার থেকে পিসিমার উগ্রীব কণ্ঠ-বউমা, ও বউমা, কি ভাঙল?
কি ভেঙেছে অর্চনা না দেখেই অনুমান করতে পারে। টেলিফোনে মুখ নামিয়ে বলল, এখন থাক মা, পিসিমা ডাকছেন–
মেয়ের কথায় ওদিক থেকে মায়ের গা জ্বলে গেল…টেলিফোনে কথা কইছিস– পিসিমা ডাকছেন কি?
পিসিমা পূজোয় বসেছিলেন, জবাব না পেয়ে আরো উৎকণ্ঠিত।–কি ভাঙল? ও বউমা–
অর্চনা এবারে সাড়া দিল, যাই পিসিমা–। এদিকে টেলিফোন ছেড়ে দিলে মা চটবেন ভেবে তাকে বলল, আচ্ছা তুমি একট ধরে মা, আমি এক্ষুনি আসছি।
রিসিভার টেবিলে নামিয়ে রেখে ভিতরের দরজা দিয়ে পাশের ঘরে এসেই অর্চনা স্তব্ধ। শাশুড়ীর ছবি মেঝেতে উল্টে পড়ে আছে, কাঁচ ভেঙে ছত্রধান। হতভম্ব হরিয়া হাতে করেই কাচের টুকরো কুড়োচ্ছ।
পূজোর আসন ছেড়ে পিসিমাও উঠে এসেছেন। ঘরের অবস্থা দেখে তিনি আর্তনাদই করে উঠলেন। হরিয়ার উদ্দেশে বলে উঠলেন, ওরে ও হতভাগা, ছবিটা ফেললি কি করে?…বউমা, দেখ ছবিটা গেল কি না…