এক ঝটকায় পরদা ঠেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সুখেন্দু বিমূঢ়, হতভম্ব। এতবড় সমর্পণের মুখে এমন এক বিপরীত আঘাত আনুভব করতেও সময় লাগে। তড়িতাহত বিস্ময়ে দরজার দিকে চেয়ে রইল সে।
.
পরদাটা নড়ছে।
বিয়ের পর ছদ্ম-অভিমানে প্রথম প্রথম এক-আধদিন সুখেন্দু ঘর-বদল আগেও করেছে।
তাতে ব্যবধান রচনার অভিপ্রায় ছিল না একটুও, বরং গাঢ়তর অনুরাগের প্রত্যাশা ছিল। অর্চনা কোনদিন উঠে এসে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেছে, কোনদিন আপস করেছে, কোনদিন বা নিরীহ মুখে নিজে হাতে তার বালিশ টালিস এনে দিয়ে গেছে–অসুবিধে যাতে না হয়। পাশের ঘরটা সুখেন্দুর শুধু পড়ার ঘর নয়, রাগ হলে গোসা-ঘরও।
তাকে গুম হয়ে থাকতে দেখলে হাসি চেপে কখনো-সখনো অর্চনা নিজেও জিজ্ঞাসা করত, কোথায় শোবে–এই ঘরে, না গোসা ধরে?
এবারে ঘর-বদলের সুরটাই একেবারে ভিন্ন-রাগের।
কোন মান-অভিমানের তাপ নেই, সাধাসাধির প্রত্যাশাও নেই। পাশের ঘরের চৌকিতে বায়ো-মাস একটা গালচে পাতাই থাকে। সুখেন্দু নিজের হাতেই দুটো বালিশ তুলে নিয়ে যায়, আবার সকাল হলে সে-দুটো এ-ঘরে, খাটে ফেলে দিয়ে তার পর বারান্দার দিকের দরজা খোলে। অর্চনা চুপচাপ দেখে একটি কথাও বলে না। রাগ চড়তে থাকে তারও, নির্মম মনে হয় মানুষটাকে সহ করাও সহজ নয়, সাধতে যাওয়া আরো বিরক্তিকর। কাণ্ড একটা সে-ও বাধাত, পিসিমার ভয়ে চুপ করে আছে। নিস্পৃহতার আবরণে গুটিয়ে রেখেছে। নিজেকে।–ক’দিন চলে চলুক। পুরুষের দুর্বার তাড়নার দিকটা তার জানা আছে।
কটা দিন বাদেই অর্চনা শুনল, কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে পাঁচ-সাত দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছে সে। সুখেন্দু নিজে বলেনি, পিসিমা তাগিদ দিয়েছেন, ওর সঙ্গে কি যাবে না যাবে সব ঠিকঠাক করে দাও–।
পিসিমা সেই চিন্তায় মগ্ন ছিলেন বলে অর্চনার অবাক হওয়াটা চোখে পড়ে নি। অর্চনাও মুহূর্তেই সামলে নিয়েছে। পরে সুখেন্দুর সামনে এসে জিজ্ঞাসা করেছে, কোথায় যাচ্ছ শুনলাম?
সুখেন্দু বই পড়ছিল। মাথা নেড়েছে।
কোথায়?
বলেছে।
এডুকেশন টুরে?
সুখেন্দু বইয়ের পাতা উল্টেছে।
আমাকে জানানো দরকার মনে করনি?
সুখেন্দু বই সরিয়েছে।–তোমার মায়ের পারমিশান নেওয়া দরকার ছিল?
মায়ের নয়, আমার জানা দরকার ছিল।
যা-যা লাগতে পারে অর্চনা গোছগাছ করে দিয়েছে। সে যাবার আগে মনটাও নরম হয়েছিল একটু, কিন্তু সুখেন্দু একটা কথাও বলে নি।
ফেরার কথা পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে। ফিরল প্রায় দিন বানো পরে। পিসিমার তাগিদে অর্চনা কলেজে টেলিফোন করে জেনেছে, কলেজের ছেলেরা যথাসময়েই ফিরে এসেছে, শুধু সে-ই ফেরে নি।
ওর যেমন রাগ পড়ে এসেছে, অন্য দিক থেকেও অর্চনা সেই রকমই আশা করেছিল। স্বাভাবিক স্থলে এই কটা দিনের বিচ্ছেদ ব্যবধান ঘোচানোর অনুকুল। কিন্তু সুখেন্দুর একটুও পরিবর্তন নেই, বরং আরো সঙ্কল্পবদ্ধ কাঠিন্য নিয়েই ফিরেছে যেন। আগের মতই নিজের হাতে বালিশ তুলে নিয়ে গিয়ে পাশের ঘরে পৃথক শয্যা রচনা করেছে। আঘাত দেবার বাসনা পোষণ করতে থাকলে চরমে না ওঠা পর্যন্ত বাড়াতেই থাকে সেটা। কদিন বাদে, পিসিমা জানালেন সে-চক্ষুলজ্জাও কাটল। পাশের ঘরের চৌকিতে একটা স্থায়ী শয্যার ব্যবস্থা করে নিল সে। টেবিলসুদ্ধ তার বই আর ঈজিচেয়ারটাও পাশের ঘরে চলে এলো। পিসিমা জানালেন, অনেক রাত পর্যন্ত আজকাল আলো জেলে পড়া না করতে হয় বলেই এই ব্যবস্থা।
তার পর থেকে পিসিমা ভাইপোকে চুপচাপ লক্ষ্য করছেন শুধু। অর্চনাকেও। মুখে কিছু বলেন নি।
কিন্তু অর্চনা বলেছে। সেদিনের সেই একান্ত প্রত্যাশার মুহূর্তে ও-ভাবে আঘাত দিয়ে ফেলে নিরিবিলি অবকাশে অনুতাপ একটু নিজেরও হয়েছে। বাপের বাড়িতে ওর সেইদিনের অপমানে অনুতাপ আর-একজনের হবার কথা। হল না যে সেইখানেই অর্চনার ক্ষোভ। তার ওপর এই রূঢ়তা আরো অপমানকর। তবুও, আগের মত না হোক, মানুষটার স্বভাব জেনে যতটা সম্ভব হালকা গাম্ভীর্যে এই গুমোট কাটিয়ে তুলতেই চেষ্টা করেছে। জিজ্ঞাসা করেছে, তোমার এই এক-একটা রাগের ঝোঁক ক’দিন পর্যন্ত থাকে বলে দাও, ক্যালেণ্ডারে দাগ দিয়ে রাখি।
ফল হয় নি। সুখেন্দুর মুখের রেখাও একটা বদলায় নি।
সেদিন নিজের কাজ সেরে এসে অর্চনা দেখে, পাশের ঘরের দেয়ালের কাছে চেয়ার নিয়ে হরিয়া চাকর নিবিষ্ট মনে দেয়ালে কতকগুলো পেরেক ঠুকছে। অর্চনা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, কি হবে। তার আগেই টেবিলটার ওপর চোখ পড়তে অবাক! টেবিলে শাশুড়ীর সেই ছবিখানা। হরিয়া ওটা খুলে এনে এ-ঘরে টাঙাবার তোড়জোড় করছে। ওদিকে পিসিমাও এসে দাঁড়িয়েছেন কখন। অবাক তিনিও। হরিয়া জানাল, কলেজ যাবার সময় দাদাবাবু তাকে ছবি ও-ঘর থেকে নামিয়ে এনে এ-ঘরে টাঙিয়ে রাখতে বলে গেছে।
পিসিমার চোখে চোখ পড়তেই অর্চনা তাড়াতাড়ি ঘরে চলে এলো। এই সামান্য একটা ব্যাপারের প্রতিক্রিয়া কম নয়। প্রথমেই মনে হল হরিয়াকে আবার আদেশ দেয়, ছবি যেখানে ছিল সেখানেই রেখে যেতে। পারল না। যেখানে লাগার লেগেছে, ছবি ফিরিয়ে এনে সেই যাতনার লাঘব হবে না। বরং হুকুম যে দিয়ে গেল হাতের কাছে তাকে পেলে সামনা-সামনি বোঝাপড়া হতে পারত। অর্চনা গুম হয়ে বসে রইল খানিক। ও-ঘরে পেরেক পোতার কি-ঠাক শব্দগুলোও কানে লাগছে। অর্চনা নিজের ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকাল। যেখান থেকে ছবিটা নামিয়ে নেওয়া হয়েছে সেখানে চৌকো দাগ পড়ে আছে একটা। সেই দিকে চেয়ে চেয়ে হঠাৎ মনে হল দাগটা যেন অশুভ সূচনা কিছুর।