মিসেস বাসু স্বামীর দিকে একটা তীব্র দৃষ্টিনিক্ষেপ করে উঠে সোজা দরজার কাছে চলে এলেন। তার পর ঘুরে দাঁড়িয়ে নীরসকণ্ঠে আদেশ দিলেন, বউমা, আর রাত না করে খাবার দেবার ব্যবস্থা করো।
বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে গটগট করে ওপরে উঠে গেলেন তিনি।
অর্চনা সকলের সঙ্গেই খেতে বসেছে। কি খেল তাও বোধ হয় সকলেই লক্ষ্য করেছে। খাওয়া শেষ হতেই ফেরার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। বাবা গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন, তাতেও আপত্তি করেনি। বাড়ি ফিরে ধীর শান্ত পায়েই ওপরে উঠেছে।
পিসিমার ঘর অন্ধকার। শুধু ওর ঘরেই আলো জ্বলছে।
বিছানায় শুয়ে সুখেন্দু অন্যমনকের মত দেয়ালে ছবিটার দিকে চেয়ে, বুকের ওপর একটা খোল বই উপুড় করা। বিছানার গা ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের অপবাদটা আজ অন্তত প্রয়োজ্য নয়। এক পলক দেখে নিয়ে অর্চনা সোজা তার ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
সাড়া পেয়ে সুখেন্দু ফিরে তাকাল। দেখল একটু। অনুতাপ প্রকাশের ৰীতি জানা নেই তেমন, চেষ্টা করে নিছক গদ্যাকারের প্রশ্নই করল একটা, হয়ে গেল?
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে অর্চনা দুল খুলছে কানের। জবাব না দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শুধু একবার, তার পর অন্য দুলটা খুলল।
তার দিকে চোখ রেখেই সুখেন্দু আধাআধি উঠে বসল। ওদিকে ফিরে থাকলেও আয়নায় সামনা-সামনি আর পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণের আপসোচিত প্রতীক্ষার পর হঠাৎই খুব ভাল লাগছে সুখেন্দুর। লোভনীয় লাগছে। মেজাজের ঝেকে অনেকদিনের উপোসী চিত্তটা যেন অভীষ্টপ্রাপ্তির তটে বসেও মুখ ঘুরিয়ে ছিল। বুকের তলায় অনেক অতনু-মুহূর্ত হারানোর খেদ।
আয়নার ভিতর দিয়ে কঠিন নিস্পৃহতায় অর্চনাও লক্ষ্য করেছে তাকে। এই মুগ্ধ দৃষ্টির ভাষা জানে। একসঙ্গে বাপের বাড়ি যাবে বলে সচেতন সাজসজ্জায় নিজেকে ঘিরে প্রলোভনের প্রচ্ছন্ন মায়া একটু রচনা করেছিল বটে। কিন্তু যার জন্যে করা, তারই এই বিহ্বল দৃষ্টি-লেহন সব থেকে বেশি অসহ্য এখন। অর্চনা ভাবল, পরিপূর্ণভাবে অপমান করতে পারার অন্তষ্টির ফলেই এই ব্যতিক্রম, সেই তুষ্টির ফলেই আর এক আনুষঙ্গিক তৃপ্তির তাগিদ। দুল টেবিলে রেখে আস্তে আস্তে ঘুরে বসল তার দিকে।
সুখেন্দু চেয়েই ছিল, অপ্রতিভ মুখে হাসল একটু।–শোন—
বলো, শুনছি।
এখানে এসো না—
অর্চনা উঠে সামনে এসে দাঁড়াল। প্রত্যাখ্যানের বর্ম আঁটা।
সুখেন্দু তার হাত ধরে কাছে টেনে বসিয়ে দিল। নিজের একটা আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সেই আনন্দটাই বড়।–রাগ করেছ?
সেটা তো তোমারই একচেটে সম্পত্তি।
সত্যি, এমন হয়–। সুখেন্দু অস্বীকার করল না।–যাইনি বলে নিজেরই
থাক। কঠিন শ্লেষে অর্চনা থামিয়ে দিল।– তাকে কি বলবে বলো।
তার রাগের মাত্রা অনুমান করে সুখেন্দু হাসল একটু। তার পর বলল, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
সুসময়ে তার চোখে এই ক’টি কথার আভাস দেখতে পেলেও অর্চনার খুশী ধরত না। এখন বিদ্রুপের মত লাগল। দারুণ বিরক্তিতে শয্যা ছেড়ে উঠতে গেল।
পারল না। দুই হাতের বেষ্টনে সুখেন্দু তাকে বসিয়েই রাখল। বাপের বাড়ি থেকে অর্চনা কি মন নিয়ে ফিরেছে তার ধারণা নেই। শুধু জানে, ও যায় নি বলেই রাগ। মনোরঞ্জনের কলাকৌশল জানা থাকলে রমণী-মনের দিকটাই আগে বুঝে নিতে চেষ্টা করত, নিজের না যেতে পারার পিছনে নরম কৈফিয়ত কিছু খাড়া করত, আর সন্তপ্ত অনুরাগে তার ব্যথাটাই আগে নিজের বুকে টেনে নিত। কিন্তু সুখেন্দু তার ধারকাছ দিয়েও গেল না, অর্চনার অপমানটা কোথায় গিয়ে বিঁধেছে খোঁজ নিতেও চেষ্টা করল না। মেজাজের বেগটা তার যেমন আকস্মিক, আবেগের মুহূর্তও প্রায় তেমনিই অশান্ত। সঙ্গতির পথে আনাগোনা নয় কোনটারই। তাই নিঃসঙ্গতার আবরণ থেকে নিজের এই সদ্য-মুক্তিটাই বিনম্র আপসের বড় উপকরণ মনে হয়েছে। যেন সেইটুকুই অর্চনার জানবার বিষয়, আর সেইটুকুই তারও জানাবার তাগিদ।
দুই হাতের নিবিড়তার মধ্যে সুখেন্দু তাকে আরও একটু কাছে টেনে নিতে চেষ্টা করল।–সত্যি, শুয়ে শুয়ে আমি এতক্ষণ তোমার কথাই ভাবছিলাম… পিসিমা খানিক আগে খুব বকে গেল আমাকে। হাসতে লাগল মৃদু মৃদু, কি বলল শুনবে?
অর্চনা কঠিন, শান্ত। শোনার কোনো আগ্রহ নেই।
আরো একটু অনুকূল মুহূর্তের আশায় পিসিমার সেই নিগুঢ় বচনটি সুখেন্দু আর একভাবে প্রকাশের চেষ্টা করল।–পিসিমা মায়ের কথা বলেও অনেক দুঃখ করে গেল…মা যে তোমাকে কত চেয়েছিল জান না।
অন্য সময়ে হলে অর্চনা টিপ্পনী কাটত, মা তাকে চায়নি, মা যে কোন একটি ছেলের বউ চেয়েছিল। এখন নির্বাক চোখে শুধু তাকাল তার দিকে। স্পর্শটুকুও যন্ত্রণার মত লাগছে।
সুখেন্দু আরো একটু কাছে ঘেঁষে এলো। মুচকি হেসে চোখে চোখ রাখল। প্রায় গোপন কিছু ফাস করে দেবার মত করেই বলল, মা আরো কিছু চেয়েছিল…!
মা আরো কি চেয়েছিল অর্চনা সেটা খুব ভালই জানে। আভাসে ইঙ্গিতে কখনো বা সরাসরি পিসিমা সেটা অনেকবারই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আজকের দুঃসহ অপমানের পর এই একজনের মুখেই সেই কথাটা শোনামাত্র দপ করে জ্বলে উঠল একেবারে। এতক্ষণের নির্বাক সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙে গুঁড়িয়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আচমকা তার হাত ছাড়িয়ে অর্চনা ছিটকে উঠে দাঁড়াল। তীব্র জ্বালায় অনুচ্চ-তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-কণ্ঠে বলে উঠল, থাক। চাকরি করে ও ছেলে না পড়ালে যাদের দিন চলে না, একটা কলম কিনে নিয়ে গেলেও খরচ নিয়ে পাঁচজনের উপদেশ শুনতে হয়–তাদের আর কিছু চেয়ে কাজ নেই!