অর্চনা দাশুর ওপরেই রেগে গেল হঠাৎ।–চুরুট ফুরিয়েছে দেখে আগে থাকতে এনে রাখতে পার না? বাক্স থেকে সরাতে তো খুব পারো।
এ-সব অনুযোগ গায়ে মাখার লোক নয় দাশু। গলা খাটো করে প্রায় উপদেশই দিল, তুমি নিচে যাও তো, ওদিকে তোমার কথাই হচ্ছে।
কিন্তু নিচে বসার ঘরে কথা যা হচ্ছে তার একটুখানি কানে আসতে অর্চনা দরজার এধারেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। অপমানের আঘাতে নিস্পন্দ। কারো কোন কথার জবাবে মায়ের নিদারুণ বিরক্তি।–কি জানি আসবে কি আসবে না, মাসের শেষ, হয়তো হাতে কিছুই নেই–আসতে হলেও তো একটা কিছু অন্তত
মা ওটুকু বলেই থেমেছেন। দাদার গলা শোনা গেছে, কি যে কাণ্ড, তা বলে আসবে না কেন?
অর্চনার মাথায় দপ করে যেন আগুন জ্বলল একপ্রস্থ। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে অতিকষ্টে নিজেকে সামলাল সে। বিতৃষ্ণায় মা আজকাল অনেক সময় অনেকের সামনেই তাদের অপদস্থ করে বসে সে-আভাস অর্চনা আগেও পেয়েছে। কিন্তু সেটা যে এ-পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে ভাবতে পারেনি।
ঘরে এসে দাঁড়াতে বিজনই সর্বাগ্রে বলে উঠল, এই তো এসেছে! এত দেরি? সুখেন্দু কই?
সকলের দৃষ্টি দরজার কাছ থেকে ফিরে এলো।
প্রথমেই অর্চনার চোখ গেল ননিমাধবের দিকে। দাদার দিকে ফিরে জবাব দিল, আসতে পারলেন না, কাজে গেছেন এখনো ফেরেননি।
তার বলার ধরনে বিজন মনে মনে অবাক একটু। বিস্ময় প্রকাশ করল, সে কি রে!
ওদিক থেকে বউদি বলে উঠল, ভারি অন্যায়, কোথায় গেছেন বলে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি—
অর্চনা বলল, আমরা ট্রামে-বাসেই চলাফেরা করি বউদি তাঁর আসা সম্ভব নয়।
বউদি থমকে গেল। মা ভুরু কুঁচকে তাকালেন, তার মানে সে আসবে না?
অর্চনা মায়ের চোখে চোখ রাখল! নিজেকে সংযত করতেই চেয়েছিল, কিন্তু সবটা সম্ভব হল না।–সে তো কারো হুকুমের লোক নয় মা, আসতেই হবে ভাবছ কেন?
রাগ ভুলে মা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। মেয়ের কথাবার্তা হাব-ভাব দুর্বোধ্য। শুধু মা-ই নয়, অন্য সকলেও হকচকিয়ে গেছে। একটু। বরুণাই সর্বপ্রথম ঘরর এই থমকানি ভাবটা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করল। অবাঞ্ছিত প্রসঙ্গটাই বাতিল করে দিয়ে তাড়াতাড়ি কাছে এসে দিদির হাত ধরে টানল, ননিদা কি এনেছেন দেখে যা–।
লঘু আগ্রহে কাচের চৌবাচ্চার কাছে নিয়ে এলো তাকে। জলের গাছগাছড়ার মধ্য দিয়ে লাল নীল হলদে সবুজ মাছগুলি খেলে বেড়াচ্ছে।
চমৎকার, না?
খুব সুন্দর। দুই এক মিনিট দেখে অর্চনা এগিয়ে এসে দাদাকে প্রণাম করল। তারপর হাত-ব্যাগ খুলে কেস থেকে ঝকঝকে একটা ফাউন্টেন পেন বার করে তার বুকপকেটে লাগিয়ে দিল।
পেনটা আবার তুলে দেখে বিজন ভারি খুশী।–বাঃ।
বরুণ সাগ্রহে এগিয়ে এলো, দেখি দাদা দেখি- পেন হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে বরুণার আনন্দে যেন লোভ ঝরে পড়ল, ও মা কি সুন্দর। এর যে অনেক দাম রে দিদি, সেই যে তোতে আমাতে একবার দোকানে দেখেছিলাম–
বিয়ের অনেক আগে একবার কলম কিনতে গিয়ে এই জিনিসই একটা দুই বোনের খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু দাম শুনেই তখন সে কলম রেখে দিয়ে অন্য কলম কিনতে হয়েছে। অর্চনার মনে আছে। মনে আছে বলেই দেখার সঙ্গে সঙ্গে এটাই কিনেছে।
বিজন জ্যেষ্ঠোচিত অনুযোগ করল একটু, কি দরকার ছিল তোর এত দামী জিনিস আনার!
কিছু মনে করবার কথা নয়, বরং তুষ্ট হওয়ারই কথা। কিন্তু বাইরের এক জনের সামনেই একটু আগে যে আলোচনা এখানে হয়ে গেছে, সেই ক্ষোভের মাথায় দাদার এই স্বাভাবিক অনুযোগের তাৎপর্য বিপরীত। অর্চনা হাসল একটু। মায়ের দিকে তাকাল এক পলক, পরে দাদার দিকে। তার পর নিরুত্তাপ জবাব দিল, জিনিস দামী না হলে যে দেয় তার দামও একটু কমে যায় দাদা, কিন্তু এমন কিছু দাম নয় ওটার, তবু যদি খুশী হয়ে থাকে। সেই ঢের–
বিজন বিব্রত, একটু আগে মায়ের সঙ্গে আলোচনাটা কানে গেছে কিনা চকিতে সেই সংশয় মনে জেগেছে। মাও ক্রুদ্ধনেত্রে তাকালেন মেয়ের দিকে, খোঁচাটা বোধগম্য না হবার মত অস্পষ্ট নয়। বউদি গম্ভীর। ননিমাধব রুমালে মুখ ঘষছে। বরুণা চোখ বড় বড় করে দিদিকে দেখছে।
আরো একটু বাকি ছিল।
দরজার বাইরে থেকে ডক্টর বানুর গলা শোনা গেল, অর্চনা এলো? ঘরে এসে মেয়েকে দেখে নিশ্চিন্ত।–এই তো, সুখেন্দু কই?
তিনি আসতে পারলেন না বাবা।
কেন? অবাক একটু।
জবাবটা দিলেন মিসেস বাসু। গম্ভীর শ্লেষে বললেন, সে কাজের মানুষ আসবে কি করে, তাছাড়া সে কি হুকুমের লোক আমাদের যে হুকুম করলেই আসবে।
বিরক্তি আর বিতৃষ্ণায় অর্চনা আরক্ত। কিছু না বুঝে ভদ্রলোক ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইলেন খানিক। শেষে মেয়ের দিকে ফিরে সহজ অর্থটাই গ্রহণ করলেন।–ও, কাজে আটকেছে বুঝি?
দিদিকে খুশী করার জন্যেই হোক, পরিবেশটা একটু সহজ করার তাগিদেই হোক, বরুণা কলমটা তাড়াতাড়ি বাবার দিকে বাড়িয়ে দিল, দেখ বাবা কি সুন্দর কলম, দিদি এনেছে।
বাবা কলম দেখলেন। তাঁর চোখেও সুন্দরই লাগল আর দামীই মনে হল। কলমের সুখ্যাতি করে সেই সঙ্গে আর যে কথাগুলো বললেন তিনি, তার জন্য দায়ী অন্তত তিনি নন। বললেন, তুই আবার এত খরচ করতে গেলি কেন, ক’টা টাকাই বা মাইনে পায় সুখেন! বুঝেসুজে না চললে ও বেচারী সামলাবে কি করে?
এই দুর্ভাবনা বাবার মাথায় কে ঢুকিয়েছে অর্চনা জানে। হয়তো আজও এই নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে তাকে, নইলে কলম দেখেই আগে খরচের কথাটা মনে হত না। ভিতরে ভিতরে অর্চনা বুঝি ক্ষেপেই গেল এবার। দাতে করে নিজেই ঠোঁট কামড়ে আড়চোখে ননিমাধবের দিকে তাকাল।