সুখেন্দু গুম হয়ে বসে রইল। এ সামাজিকতার তাৎপর্য বোঝার মত সুস্থ মেজাজ নয় এখন। উন্টে ভাবল, তার কাজটা অবহেলার চোখে দেখে অর্চনাও, আর বড়লোক দাদা নিজে এসে বলে গেছে সেটাই বড় ওর কাছে।
পরদিনও কলেজে যাবার আগে রাতের নেমন্তম্নের কথা অর্চনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সুখেন্দু চুপচাপ শুনেছে, চুপচাপ কলেজে চলে গেছে। অর্চনা নিশ্চিন্ত ছিল।
কিন্তু অভিমানের সঙ্গে বিবেচনার আপস নেই তেমন। সুখেন্দু বাড়ি ফিরল একেবারে রাতের ছেলে-পড়ানো শেষ করে। আর তার পরে ট্রামে-বাসে না উঠে দেড় মাইল পথ হেঁটে এলো।
হাতমুখ ধুয়ে একটা বই নিয়েই শুয়ে ছিল, আর মনে মনে একটুখানি উষ্ণ আনন্দ উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছিল। এতখানি রূঢ়তার দরুন একটু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ একেবারে কাটিয়ে উঠতে পারছিল না বলেই বোধ হয়।
পিসিমা ঘরে এলেন।–তুই গেলি না যে?
না।
না তো দেখতেই পাচ্ছি, না কেন?
মুখে বলল, আমার কাজটা ওদের কাছে কিছু না হলেও আমার কাছে কম নয়। তারা টাকা দেয়।
পিসিমা বিরক্ত হলেন।–টাকা দেয় বলে কি লোক-লৌকিকতা কিছু নেই, না হয় তাড়াতাড়িই আসতিস একটু।
আমার জন্যে তো আটকায় নি কিছু, যার যাওয়া দরকার সে গেছে–
যাবে না তো করবে কি, কতবার করে টেলিফোনে ডাকাডাকি-তাও তো কতক্ষণ দেরি করেছে। সন্ধ্যে থেকে ঘর-বার করেছে মেয়েটা, শেষে চোখের জল আর সামলাতে পারে না–তোর সবেতে বাড়াবাড়ি!
সঙ্গে সঙ্গে খচ করে লাগল কোথায়। এই শাস্তিই দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা ঠিকমত লেগেছে জেনে ভিতরে ভিতরে এখন অনুতপ্ত একটু। বউ নেই, এই অবকাশে পিসিমা কিছু বলবেন ঠিক করেই এসেছেন। বলেও গেলেন। তোদের হল কি আজকাল আমি তো কিছু বুঝি না, তোর শ্বশুরবাড়ি ভাল লাগে না বলে কি মেয়েটা বাপ-মা ভাই-বোন সব ছেঁটে ফেলে দেবে? সে তো ওই সংসারেই অত বড়টি হয়েছে, না কি, তা সত্ত্বেও এমন ভাল মেয়ে বলেই এ-ভাবে থাকে। ভাইপোকে নীরব দেখে পিসিমা আর একটু চড়লেন এবং আরো একটা খেদ না প্রকাশ করে পারলেন না।-এ-ভাবে চলিস তো নিজেদের সংসার নিয়ে নিজেরাই থাক তোর, দু’বছর হতে চলল একটা ছেলেপুলে হবার নাম পর্যন্ত নেই, মা’টা তো কাঁদতে কাঁদতে চোখ বুজেছে, আমার অত পোষাবে না। সেই বউ এলো, দেখে চোখ জুড়লো, ভাবলাম এবার সব হবে, হতভাগী ওপর থেকে দেখবে–তোদের ব্যাপারখানা কি?
ঠিক সময়টিতে বেশ ভালমতই একটা নাড়া দিয়ে গেলেন পিসিমা। সুখেন্দু উসখুস করতে লাগল। টেবিলের ওপর টাইমপীস ঘড়িটার দিকে চোখ গেল।… ছাত্রের বাড়ি থেকে হেঁটে না এলেও যাওয়া যেত। এখন গেলে হয়তো দেখবে অর্চনা রওনা হয়ে গেছে। অন্যমনস্কতার ফাঁকে মায়ের ছবিটাই নজরে পড়ল। মা ওর দিকেই চেয়ে আছেন।…তার চোখেও পিসিমার অনুযোগ।
কিন্তু আর একদিকের মেঘ তখন ঈশান-কোণে। ওতে শুধু ঝড়ের উপকরণ। অত্যন্ত কাছের মানুষ অপ্রত্যাশিত রূঢ়তায় দূরে ঠেলে দিলে যে অপমান, সেই অপমানের যাতনা নিয়ে অর্চনা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। ফিরেছে তারও চারগুণ বিতৃষ্ণা নিয়ে।
বাপের বাড়িতে পা দিয়েই একটা আলগা খুশীর আবরণে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করেছে সে। বাইরের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে, দাদার জন্মদিন উপলক্ষে ঘরের আগের চেহারা বদলে গেছে, দামী সোফা-সেটি এসেছে। মাঝখানের টেবিলে বড় একটা কাচের চৌবাচ্চার ওপর ঝুঁকে রঙিন মাছের খেলা দেখছে দাদা বউদি বরুণা আর ননিমাধব। চৌবাচ্চার জলের ভিতর ইলেকট্রিক বা ফিট, করা, সেই আলোয় চৌবাচ্চাটা ঝকঝক করছে। ওপর থেকে বউদি খাবারের গুড়ো ছড়িয়ে দিচ্ছে বোধ হয়।
সকলের অগোচরে অর্চনা পা-টিপেই বারান্দা ধরে সিঁড়ির দিকে এগোলে। এক্ষুনি আর-একজনের না আসার জেরার মুখে পড়তে চায় না। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতে খাবার-দ্বয়ের দিক থেকে মায়ের তপ্তক কানে এলো। বকাবকিটা দাঁতর উদ্দেশে সন্দেহ নেই। এক মুহূর্ত থেমে অচলা চুপচাপ ওপরে উঠে গেল। উদ্দেশ্য, সকলকে একটু অবাক করে দেবার জন্য একেবারে বাবাকে নিয়ে নামবে। আসলে বাবার একটুখানি ছায়া কাম্য নিজের কাছেও সেটা স্বীকার করতে চায় না। বাবার কাছে থাকলে এক মা ছাড়া আর সকলের অন্তত মুখ বন্ধ। আর দরকার হলে মাকে মুখ বন্ধ করতেও শুধু তিনিই পারেন।
ওপরে এসে দেখে বাবার ঘর ফাঁকা। অর্চনা অবাক, নিচেও তো দেখল না। এদিক-ওদিক ঘুরে দেখল একটু। ওপরে নেই। বাবার বিছানাতেই এসে বসল আবার। তাকে না পেয়ে তার কাছে আসার দুর্বলতাটা নিজের চোখেই ধরা পড়ে গেছে হয়তো। ঘরের সর্বত্র অযত্নের ছাপ, অর্চনা সেই কারণেই যেন উষ্ণ হতে চেষ্টা করল। বরুণার ওপরেই চটে গেল, অতবড় মেয়ে করে কি। শেষবার ঘর গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মাস দুই আগে, তার পর আর বোধ হয় হাত পড়েনি। তাকের উল্টো-পাল্টা বইগুলি ঠিক করে রাখল, টেবিলটাও হাতে হাতে গোছাল একটু। কিন্তু এভাবে ওপরে এসে বসে থাকাটা বিসদৃশ। মুখে একটা হালকা ভাব টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
সিঁড়ির কাছাকাছি আসতে ওপরেই দাশুর সঙ্গে দেখা। কিছু একটা হুকুম তামিল করতে এসেছিল বোধ হয়। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে অর্চনা জিজ্ঞাসা করল, বাবা কোথায়?
তাকে দেখে দাশু সানন্দে এক কথার জবাবে অনেক কথা জানিয়ে দিল। যথা দিদিমণিরা এলো না ভেবে মা বহুক্ষণ ধরেই ফাটছিলেন, সেই অবস্থায় বাবু ওকে চুরুট কিনে নিয়ে আসার কথা বলতে মা বাবুকেই দাবড়ে দিলেন, আর ওকে হুকুম করলেন কাজে যেতে। দাশুর অবশ্য হাতে তেমন কাজ নেই, কিন্তু সেটা আর তাকে বলে কেমন করে? বাবু নিজেই চুরুট আনতে গেছেন।