নিরুপায় ক্ষোভে অর্চনা জ্বলতে জ্বলতে বাড়ি এসেছিল সেদিনও। রাগ বাবার ওপরে নয়, তিনি সাদা মনেই বলেছেন জানে। রাগ মায়ের ওপর, তার গঞ্জনাতেই বাবা ভুল বুঝে বলেছেন। দাদার সামনে বউদির সামনে বরুণার সামনে অর্চনা অনেক কষ্টে সামলেছে নিজেকে, আর বাড়ি এসেই ফেটে পড়েছে একেবারে তুমি এসব ছেলে-পড়ানো মেয়ে-পড়ানো ছাড়বে কি না?
জবাবে সুখেন্দু উঠে গিয়ে পাঁচখানা দশটাকার নোট তার সামনে ফেলে দিয়ে বলেছে, তোমার মাকে দিয়ে দিও।
অর্চনা চুপ একেবারে। আগের দিনই মা কি এক চ্যারিটি শো-এর টিকিট পাঠিয়েছেন দুটো।
নতুন কিছু নয়। উঁচু-মহলের পরিচিত জনের রিলিফ-ফাণ্ড চ্যারিটি শো, অথবা অন্য কোন নিয়মিত উৎসবের টিকিট বিক্রি করতে এলে আত্মসম্মানের তাগিদে মা নিজের জন্য তো বটেই, তাদের অনুরোধে মেয়ে-জামাইয়ের জন্যেও টিকিট না কিনে পারেন না। অবশ্য মেয়ে-জামাইয়ের কাছ থেকে টাকা না নেবার কথা ভেবেই টিকিট কেনেন তিনি। কিন্তু প্রতিবারেই মেয়ের কাছ থেকে হাত পেতে তাকে টাকা নিতে হয়। প্রথম যেবার নিতে চাননি, মেয়ে সেবার টাকা ক’টা একরকম ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই চলে গিয়েছিল। কারণটা অবশ্য তিনি জানতেন না। কারণ ছিল। টাকা দেবার দরকার নেই বলায় সুখেন্দু অর্চনার সামনে ঠিক ওভাবেই টাকা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল।
শুধু এই ব্যাপারে নয়, মা একখানা ভাল শাড়ি কিনে পাঠালে পর্যন্ত সুখেন্দু প্রায় আদেশের সুরেই বলে, দাম জেনে দাম দিয়ে দিও। মাসকাবারে টেলিফোনের খরচটাও সে-ই যুগিয়ে আসছে, মা দেবে অর্চনা এ-কথাটা বলতেও ভরসা পায়নি। এমন কি বাড়ির গাড়ি অর্চনাকে নিতে এলেও অসন্তুষ্ট হয়, বলে, গাড়ি পাঠাতে বারণ করে দিও, ট্যাক্সিতে যাবে।
অর্চনা হাসিমুখেই বলেছে একদিন, তুমি তো সঙ্গে যাচ্ছ না–ট্যাক্সিঅলা এই ভরসন্ধ্যেয় আমাকে নিয়ে যদি নিজের খুশিমত একদিকে গাড়ি ছোটায়, তখন?
সুখেন্দু গম্ভীর মুখে টিপ্পনী কেটেছে, ট্যাক্সিতে উঠেই তোমার মায়ের পরিচয়টা দিয়ে দিও আগে, তাহলে আর সাহস করবে না।
অতএব মাইনের টাকায় যে কুলোয় না সেটা ঠিকই। কিন্তু রাগের মাথায় অর্চনার সব সময় সেটা মনে থাকে না। আর থাকে না যখন সুখে এমনি শান্ত অথচ রূঢ়ভাবেই খরচের দিকটা স্মরণ করিয়ে দেয় তাকে। অর্চনা ভাবে মাকে নিষেধ করে দেবে এভাবে যেন খরচ না বাড়ান তিনি। কিন্তু পারে না, তাতে করে বাড়ির সকলেই আরো একটু করুণার চোখে দেখবে। তাছাড়া এ-সংসারের কল্পিত অনটনের ক্ষোভটাই মা ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করে তুলবেন আরো।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই মর্মান্তিক ব্যাপার ঘটে গেল আবারও। বিজনের জন্মদিন উপলক্ষ সেটা। একান্ত ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেও এবারে এই দিনটার সার্থকতা একটু অন্যরকম। বিজনের কাছে তো বটেই, তার মায়ের কাছেও। ইতিমধ্যে বিজনেরও একখানা গাড়ি হয়েছে, সেই গাড়ি চড়ে ননিমাধবকে নিয়ে আগের দিন সে নিজেই এসে অর্চনাকে বলে গেছে। সুখেন্দু বাড়ি ছিল না, সকালের ট্যুইশন সারতে বেরিয়েছিল।
অর্চনা খুশী হয়েছিল। তাদের বাড়িতে ননিমাধবের সেই প্রথম পদার্পণ। তাকে হাসিমুখে আদর-আপ্যায়ন করেছে। দাদাকে বলেছে, তুমি হোমরাচোমরা মানুষ এখন, নিজে নেমন্তন্ন করতে এসেছ, যাব না বলে কি?
চেষ্টা-চরিত্র করে ননিমাধব বলেছে, আজকাল তো তেমন আসোটাসো না
অর্চনা তক্ষুণি জবাব দিয়েছে, আমাদের তো আর আপনাদের মতো দুজনের দুটো গাড়ি নেই, ইচ্ছে থাকলেও যখন-তখন যাই কি করে! আর বলেছে, আপনি আসতে খুব খুশী হয়েছি, একদিনও তো আসেননি!
এর পর তার পকেটের রুমাল আর পকেটে থাকেনি। অর্চনা তার দিকে চেয়ে সকৌতকে মন্তব্য করেছে, টাকাই করুন আর গাড়িই করুন, সাইকেল-রিকশর ব্যবসায় কিন্তু আপনাকে মানায় না।
পার্টনারের মুখের অবস্থা দেখে বিজনের পর্যন্ত হাসি পেয়ে গিয়েছিল। যাবার আগে আবারও বলেছে, যাস কিন্তু তোরা তাহলে, সুখেন্দুর সঙ্গে দেখা হল না–
দেখা হল না বলেই অর্চনা ভিতরে ভিতরে স্বস্তিবোধ করছে। এসেই চান করে কোনরকমে দুটি মুখে দিয়ে কলেজে যাবার তাড়া। সেই ব্যস্ততার মধ্যে বসে দু মিনিট কথা বলার ফুরসৎও পাবে না। অতিথিরা সেটা না বুঝে ক্ষু হতে পারে।
–আমি বল’খন। চকিতে অর্চনা কি ভেবেছে একটু।–তুমি না হয় পিসিমাকেও বলে রেখে যাও।
বিজন তাই করেছে। পিসিমা খুশী হয়ে অনেক আশীর্বাদ করেছেন।
সকালে অর্চনা সুখেন্দুকে নিজে কিছু বলার অবকাশ পায়নি। তবে তাব খাবার সময় পিসিমা বলেছেন শুনেছে। অর্চনা বিকেলে বলেছে। অন্যত্র যে কোন জায়গায় যাবার কথা উঠলে সুখেন্দুর আগ্রহ অন্যরকম হত। কোথাও যাবার নাম করে অর্চনা দু-পাঁচদিন ছুটি নেবার কথা বললেও হয়তো খুশী হয়েই রাজী হয়। মাঝে-মধ্যে আশাও করেছে তার এত খাটুনি দেখে অর্চনা বলবে। প্রথম দিনের সেই একান্ত দুজনের দিনগুলির লোভ সুখেন্দুর এই একটানা নিস্পৃহতার তলায় তলায় ছড়িয়ে আছে এখনো। যাকে পেয়েছে সেটা কম পাওয়া নয় উপলব্ধি করে বলেই মনে মনে প্রত্যাশা বেশি। তাই অভিমানও বেশি। আর তাই উদাসীনতার রূঢ়তাও বেশি।
আমি যাব কি করে, কাল তো ছুটির দিন নয়!
রাত্রিতে তো—
রাত্রিতে বাড়ি বসে থাকি?
অর্চনা জোর দিয়ে বলেছে, একটা দিনের ব্যবস্থা করে নাও-ও-কাজ তো রোজই আছে। দাদা নিজে এসে বলে গেছে, না গেলে ভয়ানক বিচ্ছিরি হবে।