মিসেস বাসু কথাটা শুনে যে-ভাবে তাকালেন, যেন মুখের ওপর ঠাস করে অপমান করা হল তাকে। প্রথমে অবাক, পরে ক্রুদ্ধ। সুখেন্দু ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বারান্দার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেছে। চকিত বিমুঢ় নেত্রে অর্চনা একবার সেদিকে আর একবার মায়ের রক্তিম মুখের দিকে চেয়েই উঠে তাড়াতাড়ি সিঁড়ির কাছে এগিয়ে এলো। সুখেন্দু অর্ধেক সিঁড়ি নেমে গেছে।
তুমি বেরুচ্ছ নাকি?
সুখেন্দু ঘুরে দাঁড়াল, তার দিকে শুধু তাকাল একবার, তার পর নিচে নেমে গেল।
অর্চনা সিঁড়ির মুখেই দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।
.
এইটুকু সংসারে খুশীর বাতাস ক্রমশ যেন কমে আসছে। দিনে দিনে অনভিপ্রেত ছায়া পড়ছে একটা।
অর্চনা চেষ্টা করে আগের সেই আনন্দ-ছোঁয়া দিনগুলির মধ্যে ফিরে যেতে। কিন্তু সেটা আর সহজ হয়ে উঠছে না খুব। শাশুড়ীর নির্দেশমত না হোক, সুখেন্দু রোজগার বাড়ানোর ব্যাপারে সচেতন হয়েছে ঠিকই। সকালে সপ্তাহে তিনদিন এম. এ-র ছাত্রী পড়াত, বিকেলেও তিনদিন তিনদিন করে আরো দুটি কলেজের ছাত্রের ভার নিয়েছে। প্রাইভেট কলেজের মাস্টার, সেদিক থেকে কোন বাধা নেই।
ট্যুইশন সেরে ফিরতে তার রাত হয় প্রায়ই। চুপচাপ খাওয়া-দাওয়া সেরে তার পরেও বই নিয়ে পাশের ঘরে পড়তে বসে যায়। ইদানীং পড়ার ঝোঁক বেড়েছে। বেশ রাত করেই শুতে আসে। অচর্ন জেগে কি ঘুমিয়ে ভাল করে লক্ষ্যও করে না। শুয়েই ঘুম। অর্চনার এক-একদিন ইচ্ছে করে ঠেলে তুলে দিতে–এই মেজাজ নিয়ে বিছানায় গা ঠেকাতে না ঠেকাতে এমন ঘুম আসে কি করে ভেবে পায় না। ইজিচেয়ারে বই পড়তে পড়তেও ঘুমিয়ে পড়ে এক-একদিন। অর্চনা ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে নিয়ে আসে। আর বলেও, সুবিধে যদি হয় তোমার বিছানাটা কাল থেকে এ-ঘরেই করে দেব না হয়।
পিসিমা লক্ষ্য করেন সবই। কোথাও একটা গোযোগ শুরু হয়েছে সেটা তিনি ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন। ছেলে বেশির ভাগই চুপচাপ, বউয়ের মুখেও আগের সেই হাসি লেগে নেই। তার মায়ের সেদিনের সেই বিসদৃশ ব্যবহার মন থেকে ঝেড়েই ফেলেছিলেন তিনি। কিছুটা সুখেন্দুর হাব ভাব দেখে, কিছুটা বা বউয়ের প্রতি মমতায়। এই ব্যাপারের কয়েকদিন পরেই গুরুদেবের সঙ্গ ধরে দিনকয়েকের জন্য কাশী যাবার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। অর্চনা একটু চুপ করে থেকে শেষে বলেছে, তার থেকে আমাকেই বিদেয় করে দিন পিসিমা!
বালাই-ষাট! পিসিমা হকচকিয়ে দু-হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে শেষে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন। শেষে রাগ করে বলেছেন, আর কখনো যেন তোমার মুখে এ-কথা না শুনি বউমা। তুমি যে কি, জানলে আর এমন কথা মুখেও আনতে না। তোমার শাশুড়ীর ওই ছবিটার দিকে চেয়ে দেখো!
তিনিই শুধু মনে কোন ক্ষোভ রাখেননি। এমন কি অর্চনার মায়ের ওপরেও না। ভেবেছেন আধুনিক শিক্ষিত মহিলা, এসব সেকেলে ব্যাপার…চোখেও হয়তো সত্যিই লাগে-তাই বলে ফেলেছেন। না বলে মনে মনে পুষে রাখলে কি আরো ভাল হত–তাকে উদ্দেশ করে হয়তো কিছুই বলেননি।
মায়ের কাছে জামাইয়ের তিন-তিনটে টুইশনের খবর অর্চনা বলেনি। তবু জানতে বাকি নেই তার। অন্তর্দাহ তাঁরও দিনে দিনে আরো পুষ্ট হচ্ছে বই কমছে না।
কারণও আছে।
এই দেড় বছরে বিজন আর ননিমাধবের ব্যবসা বলতে গেলে তিনগুণ স্ফীতি লাভ করেছে। অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যটা মহিলার প্রত্যক্ষভাবে যেমনই আনন্দের কারণ, পরোক্ষভাবে তেমনই অনুশোচনার উৎস-ব্যবসায়ের অর্ধেক মালিক ননিমাধব ছেলেটা একেবারে হাতের মুঠোয় ছিল। কেন জোর করেই বিয়েতে বাধা দেননি, সেই পরিতাপটা তিলে তিলে বাড়ছে এখন। এমন কি, বিজনও তার মনের কথা বুঝেই যেন আপসোস করেছে, বাবার আর দুটো দিন সবুর সইল না, দেখলে তো…
ননিমাধব যত বড় আঘাতই পাক, এ বাড়ির সংস্রব ত্যাগ করেনি। এখনো অর্চনাকে দেখলে মুখে তার রুমাল ওঠে, সন্তর্পণে বড় নিশ্বাস ফেলে। মিসেস বার চোখ এড়ায় না, সখেদে নিশ্বাস ফেলেন তিনিও। মনে মনে ভাবেন, যেমন কপাল– সম্ভব হলে বরুণার সঙ্গেই বিয়ে দিতেন। কিন্তু তা হয় না, বরুণা বি. এ. পড়লেও অর্চনার থেকে চার বছরের ছোট। বয়েসের অনেক তফাত হয়ে যায়। সেটা বিজনই মাকে বলেছে। মন বোকর জন্য বরুণার বিয়ের ভাবনাটা প্রকারান্তরে ননিমাধবকে একদিন শুনিয়েছিল সে। ননিমাধব বলেছে, বরুণা ছেলেমানুষ, অল্পবয়সী একটি ভাল ছেলে খোঁজ করা দরকার। খোঁজটা সেও করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।
ব্যবসায় এমন আচমকা শ্রীবৃদ্ধির ফলেই নিজের জামাইকে আরো বেশি অকর্মণ্য মনে হয়েছে মিসেস বাসুর। তার ওপর এই টুইশনের খবর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত। তার মতে এ-ও নিশ্চেষ্টতার নজির ছাড়া আর কিছু নয়। জ্বালাটা গোপন করা সম্ভব হয় নি তার পক্ষে। কখনো টেলিফোনে কখনো বা সামনাসামনি মেয়েকে বলেন, এভাবে বাড়ি বাড়ি ছেলে পড়িয়েই কাটবে তাহলে, কেমন?
রাগের মাথায় অর্চনা ফিরে মাকেই পাঁচ কথা শুনিয়ে দেয়, আবার যার জন্যে বলা ঘরে এসে এক-একদিন তার সঙ্গেও বোবাপড়া করতে ছাড়ে না। এরই মধ্যে একদিন বাবাও তাকে ডেকে বলেছেন, সুখেন্দুর অত খাটুনির দরকার কি, খরচপত্র খুব বেশি নাকি রে? দরকার হলে আমার কাছ থেকে কিছু কিছু নে না–বিজু তো টাকা-পয়সা দিচ্ছেই এখন, কোন অসুবিধে হবে না।