দেখা গেল সিঁড়ি দিয়ে অর্চনা নেমে আসছে আর ওপরের রেলিং-এর মাথায় সুখেন্দু দাঁড়িয়ে। পিসিমা হাসিমুখে বললেন, এই তো–আমি একটু আগে বউমাকে বলছিলাম টেলিফোন এলে দু-বেয়ানে দু-দিক থেকে টেলিফোন কানে দিয়ে বসে থাকব।
মিসেস বাসু একবার শুধু তাকালেন তার দিকে, পরে মেয়ের দিকে ফিরলেন। নীরব তাচ্ছিল্যটুকু এমনই স্পষ্ট যে পিসিমা বিব্রত মুখে ওপরের দিকে চোখ তুলে দেখেন সুখেন্দুও তাঁর দিকেই চেয়ে আছে।
মিসেস বাসু মেয়েকে বললেন, কোথা দিয়ে কি হবে না হবে দেখতে এলাম–
অর্চনা বাধা দিল, আচ্ছা সে-সব হবে’খন, তুমি ওপরে চলো।
তুই হড়বড় করিস না, দেখতে শুনতে বুঝতে দে–
দেখতে শুনতে বুঝতে বুঝতে অর্চনার পাশ কাটিয়ে আগে আগেই ওপরে চললেন তিনি। সুখেন্দু সরে গেছে। অর্চনা এবং তার পিছনে পিসিমাও পায়ে পায়ে উপরে উঠতে লাগলেন। একটু আগের উপেক্ষা সত্ত্বেও গৃহকত্রী হিসাবে পিসিমা নিচের থেকেই সরে যেতে পারলেন না।
ওপরে উঠেই সামনের দেয়ালের বারান্দায় টাঙানো চিত্ৰিকরা কুলো, উবুড় করা ডাল। আর পেরেকে ঝোলানো জপের মালার দিকে চোখ পড়তে মিসেস বাসু থমকে দাঁড়ালেন। টেলিফোন প্রসঙ্গ ভুলে গেলেন, চোখে যেন হুল ফুটছে তার। এ-সব সামগ্রী কার জেনেও রাজ্যের বিরক্তিতে মেয়ের উদ্দেশেই বলে উঠলেন, ও কি রে! এখনো সেই ডালা কুলো মালা? সেই কবে না এগুলো এখান থেকে সরাতে বলেছিলাম তোকে–কি যে রুচি তোদের বুঝি না, বাইরের লোক দেখে ভাবে কি?
ত্রস্তে ঘাড় ফেরাল অর্চনা। পিসিমা তার পিছনেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। লজ্জায় সঙ্কোচে অস্ফুটকণ্ঠে বলে উঠল, আঃ মা–চলো, ঘরে চলো—
তাঁকে একরকম ঠেলে নিয়েই ঘরে ঢুকে গেল সে। হতভম্ব মূর্তির মত পিসিমা দাঁড়িয়ে রইলেন আরো কিছুক্ষণ। তার পর আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে দেয়ালের পেরেক থেকে মালাটা তুলে নিলেন। শ্লথ পায়ে বারান্দার মাথায় নিজের ঘরের দিকে এগোলেন তিনি। অতিথি আপ্যায়নে তাঁর কোন প্রয়োজন নেই বুঝে নিয়েছেন। এক কোণে হরিয়া বসে পূজোর বাসন মুছে রাখছিল। তাকে বললেন দেয়াল থেকে ওই ভাল কুলো নামিয়ে তার ঘরে রেখে আসতে।
ওগুলো ওখানেই থাকবে।
চকিতে ফিরে তাকালেন পিসিমা। তারই ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সুখেন্দু। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করাও লজ্জার, পিসিমা তাড়াতাড়ি অন্যদিকে সরে গেলেন।
অর্চনাও মায়ের ওপর যথার্থ ই বিরক্ত হয়েছে। এসেই এ-রকম একটা কাণ্ড করে বসবে ভাবেনি। তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে ক্ষুব্ধ অস্বস্তিতে বলে উঠল, ছি ছি ছি, পিসিমা কি ভাবলেন বলো তো?
পিসিম। যাই ভাবুন, মায়ের চোখে মেয়ের এই সঙ্কোচটাই বেশি দুর্ভাবনার কারণ।–তুই চুপ কর, পিসিমার মুখ চেয়ে আমাকে কথা বলতে হবে?
মুখ চেয়ে কথা বললে ক্ষতিটা কোথায় সেটা মাকে বোঝানোর চেষ্টা বিড়ম্বনা। অর্চনার বিরক্তি বাড়লো আরো।–কি দরকার মা তোমার এ-সব নিয়ে মাথা ঘামানোর, এমন এক একটা কাণ্ড করে বসো তুমি লজ্জায় মাথা কাটা যায়। হুট করে একটা টেলিফোন এনে বসলে–এই সেদিন মাসিমার কাছে প্রিন্সিপাল হওয়া-টওয়া নিয়ে কিসব বলেছ–
আগের সঞ্চিত ক্ষোভটাও মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
অবোধ মেয়ের কথা শুনে মিসেস বাসু অবাক প্রথমে। মাসিমা অর্থাৎ বোনের কাছে কি বলেছিলেন তাও মনে পড়েছে।-ও… এই নিয়েও তোকে কিছু বলেছে বুঝি? মেয়ের দিকে চেয়ে জামাইয়ের সাহসের পরিমাণটা আঁচ করতে চেষ্টা করলেন তিনি। তার পর চাপা রাগে কিরে ধমকেই উঠলেন প্রায়, মাসিমার কাছে যা বলেছি তাই যাতে হয় সেই চেষ্টা কর–এই চারশ টাকাতেই দিন চলবে ভাবিস?
সুখেন্দু ঘরে ঢুকল। মায়ের কথা কানে গেছে সেটা তার দিকে একবার চেয়েই অর্চনার অনুমান করতে ভুল হল না। আর জামাইকে হাতের কাছে পেয়ে তাকেই একটু সমঝে দেওয়া প্রয়োজন মনে করলেন মিসেস বাসু। স্পষ্ট অথচ মোলায়েম করে বললেন, এই যে সুখেন্দু, সেদিন তোমার মাসি-শাশুড়ীর কাছে কি বলেছি না বলেছি তাই শুনে নাকি রাগ করেছ শুনলাম।
আঃ, মা-রাগের কথা তোমাকে কে বলল?
বাধা পেয়ে মা বিরক্ত চোখে মেয়ের দিকে শুধু তাকালেন একবার, তার পর জামাইয়ের দিকে ফিরলেন।-যা বলি তোমাদের ভালর জন্যেই বলি। তোমাকেও উন্নতির চেষ্টা করতে হবে, আর ওকেও ওর সংসার বুঝে নিতে হবে–তোমাদের সংসার চিরকাল তো কেউ আগলে বসে থাকবে না।
এ-ধরনের আভাস জামাইকে আগেও দিয়েছেন তিনি। অর্চনার নিরুপায় অবস্থা। মিসেস বানু উঠে জানালার কাছে পানের কুঁচি ফেলতে গিয়ে নিচের দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা সমস্যার সমাধান চোখে পড়ল যেন।–এই তো রে অর্চনা, এখান দিয়েই তো টেলিফোনের লাইনটা সবাসবি তোদের ঘরে আসতে পারে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুখেন্দু আলনা থেকে জামা টেনে নিয়ে গায়ে পরছে। আর অস্বস্তি নিয়ে তাই দেখছে অর্চনাও। উনি ফিরে চেয়ারে এসে বসলেন আবার। কর্তব্যবোধে যেটুকু বলা হয়েছে তার জন্য একটুও চিন্তিত নন। বললেন, ভাল কথা, সামনের শুক্রবার তো ছুটি তোমাদের? সেদিন দুপুরে আমাদের ওখানেই খাবে, অর্চনাকে নিয়ে একটু সকাল সকালই যেও, বরুণা বলে দিয়েছে। বিজুই খাওয়াচ্ছে অবশ্য, কন্টাক্ট সাপ্লাই করল একটা
দুই এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সুখেন্দু খুব শান্ত মুখে বলল, আমাদের যেতে হলে পিসিমাকে বলে যান।