মেয়ের বাড়িতে একটা টেলিফোন আনার তোড়জোড় অনেকদিন ধরেই করছিলেন তিনি। টেলিফোনের অভাবে অর্চনার কতটা অসুবিধে হচ্ছে সেটা ভাবেননি। নিজের অসুবিধে দিয়েই মেয়ের অসুবিধেটা বড় করে দেখেছেন। অযাচিত ভাবে হুটহুট করে মেয়ের বাড়িতে কত আর আসা যায়, একটা টেলিফোন থাকলে অনেক ঝামেলা বাঁচে।
কিন্তু টেলিফোন চাই বললেই টেলিফোন মেলে না আজকাল। এর জন্যে তদবির তদারক যা করা দরকার তিনিই করেছেন। খরচাপও সব তারই। টেলিফোনের স্যাংশান পাওয়া গেল সেই রাত্রে বোনকে জামাই দেখানোর কয়েকদিনের মধ্যেই। সেইদিন জামাই কি মন বা কি মেজাজ নিয়ে গেছে সেটা তাঁর পক্ষে অনুমান করাও সম্ভব না। আপাতত টেলিফোন এনে ফেলতে পারার কৃতিত্বে বিভোর তিনি।
সুখেন্দু খবরটা জানল, টেলিফোন অফিসের লোক এসে যখন বাড়ি দেখেশুনে গেল তখন।
জনাকতক লোক বাড়ির সামনেটা অনেকটা খুঁড়ে ফেলেছে। গর্তের ভিতর দিয়ে টেলিফোনের তার বাড়ির দিকে গেছে। অর্চনা পাশের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে তাই দেখছিল। টেলিফোন একটা এলে মন্দ অবশ্য হয় না, কিন্তু সুখের নিস্পৃহতায় খুব স্বস্তিবোধ করছে না। এই কটা দিনের মধ্যে আগের মত হাসিমুখে কথাও বলেনি তার সঙ্গে। তারপর মায়ের এই টেলিফোন আনার ব্যবস্থাপত্র দেখে একেবারে চুপ।
পিসিমাও রাস্তা খোঁড়ার ব্যাপারটা আজই নতুন দেখলেন। গঙ্গাস্নান পুজো-আর্চা নিয়ে থাকলেও তার চোখে বড় এড়ায় না কিছু। ক’দিন ধরেই ছেলের ভাবগতিক অন্যরকম লক্ষ্য করছেন। সেদিনও সকালে গন্যমান সেরে ওপরে উঠে দেখেন, গম্ভীর মনোযোগে বসে কাগজ পড়ছে সে। কি ভেবে ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে সুখেন, বাড়ির সামনেটা ওরকম খুঁড়ে ফেলেছে কেন?
সুখেন্দু মুখের সামনে থেকে কাগজ সাল।–টেলিফোন আসছে।
টেলিফোন! আমাদের এখানে?
সে রকমই তো শুনছি। মুখের ওপর খবরের কাগজ তুলল আবার।
টেলিফোন আসছে সুখবরই, তা বলে ছেলের মুখ ও-রকম কেন পিসিমা বুঝে উঠলেন না। চুপচাপ একটু নিরীক্ষণ করে ফিরে এলেন তিনি। পাশের ঘরের জানালার কাছে অর্চনাকে দেখেছিলেন, বারান্দার এ-মাথায় এসে কি ভেবে ডাকলেন তাকে।…মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে অর্চনা কাছে এসে দাঁড়াল।
বাড়িতে নাকি টেলিফোন আসছে? খুশী মূখেই জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
হ্যাঁ পিসিমা, উঠে পড়ে লাগতে হয়ে গেল, এত সহজে হয় না।
পিসিমা হেসে বললেন, খুব ভাল হল, দুই বেয়ানে সারাক্ষণ দুদিক থেকে টেলিফোন কানে দিয়েই বসে থাকব।
অর্চনাও হাসল তাঁর সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু হাসিটা তেমন সহজে আসছে না। বলল, মা হয়তো এসে পড়বেন এক্ষুনি।
তাই নাকি! তোমার মা পারেন, আমাদের মত জবুথবু নন। একটু থেমে হঠাৎ নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ বউমা, আজ কদিন ধরেই সুখেনকে যেন কেমন কেমন দেখছি–কি হয়েছে? শরীরটরির ভাল তো?
অর্চনা বিব্রতমুখে জবাব দিল, ভালই…।
যাক, আমার ভাবনা হয়েছিল। যে রাগ-চাপা ছেলে। ভাল কথা, বেয়ানকে না খাইয়ে ছেড়ো না কিন্তু, আমি দেখি ওদিকে ওরা কি করছে
তিনি চলে গেলেন। অর্চনা পায়ে পায়ে নিজের ঘরে এসে দেখে খবরের কাগজের দু-পাট খুলে সেই একভাবেই মুখ আড়াল করে বসে আছে মানুষটা। খানিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। এই ভাবগতিক আর বেশি বরদাস্ত করতেও ভাল লাগল না তার। এগিয়ে এসে আলমারির মাথা থেকে আর একটা পুরনো খবরের কাগজ টেনে নিল। তারপর অন্য হাতে কোণ থেকে মোড়াটা তুলে পা টিপে সুখেন্দুর ঠিক সামনে রেখে মুখোমুখি বসল।
সুখেন্দুর হাতের কাগজ নড়ল এবার। কাগজ সরিয়ে দেখে, ঠিক তারই অনুকরণে অর্চনা দু-হাতে মুখের সামনে কাগজ মেলে সর্বাঙ্গ ঢেকে বসে আছে।
ভুরু কুঁচকে দেখল একটু, তারপর আবারও কাগজ পড়ায় মন দিল–
মুখের সামনে থেকে এবারে অর্চনা আস্তে আস্তে কাগজ সরিয়ে তাই দেখে নিজের হাতের কাগজটা একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর খপ করে সুখেন্দুর কাগজ ধরে এক টান। কাগজটা ছিঁড়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে অর্চনা জিব কাটল। তার পরেই জোর দিয়ে বলে উঠল, বেশ হয়েছে পিসিমা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করছিলেন তোমার কি হয়েছে! মা সেই কবে কি না কি একটা কথা বলেছে, তুমি এখনো তাই ধরে বসে আছ!
সুখেন্দু নিস্পৃহ জবাব দিল, আমি কিছুই ধরে বসে নেই।
তবে? ও, টেলিফোন!
জবাব না দিয়ে সুখেন্দু খবরের কাগজে চোখ রাখল।
তোমার আপত্তি সে কথা তুমি মাকে বলে দাওনি কেন? ক’মাস ধরেই তো শুনছ টেলিফোনের কথা–
সুখেন্দু বলল, তোমার মা টেলিফোন আনছেন তোমার সুবিধের জন্য, আমি আপত্তি করতে যাব কেন?
বিরক্তিতে অর্চনা মোড় ঠেলে উঠে দাঁড়াল একেবারে।– দেখ, এই জন্যেই তোমার উপর আমার রাগ হয়–আমার সুবিধে কি অসুবিধে সেটা তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেই তো পারতে–আমি কি বাইরের কেউ?
বোঝাপড়াটা ঠিকমত করে ওঠার অবকাশ পাওয়া গেল না। নিচে গাড়ি থামার শব্দে মায়ের আবির্ভাব ঘোষণা। অচন। অনুনয় করল, এভাবে বসে থেকো না, লক্ষ্মীটি, ওঠো–
বাইরের মাটি খোঁড়ার কাজ দেখতে দেখতে হৃষ্টচিত্তে মিসেস বাসু ভিতরে ঢুকলেন। পিসিমা নিচে ছিলেন, টের পেয়ে চাবির গোছা বাঁধতে বাঁধতে হাসিমুখে অভ্যর্থনায় এগিয়ে এলেন।-নমস্কার বেয়ান, আসুন–আপনি আসছেন বউমা বলেছে।
ওভাবে চাবির গোছা আঁচলে বাঁধাটাও মিসেস বাসুর চোখে বিরক্তিকর। আর কার চাবি কে আঁচলে বাধে ভিতরে ভিতরে হয়তো সেই খেদও একটু। আপ্যায়নের জবাবে মাথা নাড়ালেন কি নাড়ালেন না।–অর্চনা কোথায়?