ডক্টর বাসু স্ত্রীর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রচ্ছন্ন কৌতুকে আলাপটা আর একটু রসিয়ে তুলতে ছাড়লেন না। যেন সত্যিই প্রশংসাই করা হয়েছে ঠার, বললেন, জানাশোনা থাক আর নাই থাক, তোমার পছন্দ না হলে কি আর কিছু হত?
শুধু পলকের দৃষ্টিবাণে যতটুকু আহত করা চলে তাই করলেন মিসেস বাসু। কিন্তু ভদ্রলোক আর বসে থাকাটা যুক্তিযুক্ত বোধ করলেন না। কাজের অছিলায় তাঁদের গল্প করতে বলে প্রস্থান করলেন।
ভগ্নীপতি জিজ্ঞাসা করলেন, জামাই বাবাজী কতদিন প্রফেসারি করছেন?
বাড়ির কেউ না থাকাতে মিসেস বাসু স্বস্তি বোধ করলেন। এক প্রশ্নের জবাবে অনেক কথা বললেন। খুব বেশিদিন নয়, তবে উপযুক্ত ছেলে তো, চট করেই উন্নতি করেছে–এই শিগগিরই ভাইস-প্রিন্সিপাল হবে শোনা যাচ্ছে, তারপর থিসিস-টিসিস্ লিখছে, বিলেতও যাবে ফিরে এলেই প্রিন্সিপালও হবে আর কি…।
বেশ, বেশ—। ভগ্নীপতির খুশীর অভিব্যক্তি।
মাসি বললেন, খুব ভাল।
একটু বাদেই বাইরে গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল। মিসেস বাসু গম্ভীর হলেন। বোন জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা এলো নাকি?
জবাব নিষ্প্রয়োজন, অর্চনা উৎফুল্ল মুখে দৌড়েই ঘরে ঢুকেছে। পিছনে সুখেন্দু। মাসি সানন্দে বলে উঠলেন, এই তত! আয় আয়, আমরা সেই কাল থেকে তোদর জন্য বসে আছি
অর্চনা হাসিমুখে মাসি আর মেসোকে প্রণাম করল।–বসে না থেকে একবার গিয়ে হাজির হলেও তো পারতে?
মিসেস বাসু সুখেন্দুকে বললেন, তোমার মেসোমশাই আর মাসিম, প্রণাম করো।
যথা-নির্দেশ।
মাসিমা আশীর্বাদ করতে করতে জামাই যাচাই করে নিলেন। মেসোমশাই বললেন, বোসো। বাবা বসে–তোমার কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ, বড় খুশী হয়েছি।
খুশীর খবরে সুখেন্দুর বিড়ম্বিত মূর্তিটি দেখে অর্চনা হাসি গোপন করল। মাসি বললেন, আমি ভাবলাম আজ আর এলিই না বুঝি
তোমরা এসেছ শুনেও আমি আসব না। একটু দেরি হয়ে গেল অবশ্য—
একটু …মায়ের ঠাণ্ডা বিরক্তি, দেরিটা হল কেন?
বাড়িতে লোক এসে গেল।-এক নিশ্বাসে মাসির যাবতীয় খবরাখবর নিয়ে অৰ্চনা উঠে দাঁড়াল।-বাবা কোথায় মা? ওপরে? মাসিমা, আমি আসছি
.
কিছুটা হেঁটে এসে সুখেন্দু ইশারায় একটা ট্যাক্সি থামাল।
অর্চনা অবাক। বাবা বাড়ির গাড়ি দিতে চেয়েছিলেন, নেয়নি। বাবার সঙ্গে গল্প করে, বরুণা আর বউদির সঙ্গে হৈ-চৈ করে, ঘণ্টাখানেক বাদে নিচে নেমে মানুষটার মুখের দিকে চেয়েই অৰ্চনা বুঝেছিল গোযোগর ব্যাপার কিছু ঘটেছে। কিন্তু মাসি-মেসোর সামনে কি আবার হতে পারে। জামাই শরীর ভাল নেই বলে চাটুকুও মুখে দিল না, তাই তারা চিন্তিত। অর্চনাকে দেখে মাসি বলেছেন, একজন ডাক্তার-টাক্তার দেখা–এই বয়সে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হলে চলবে কেন?
অৰ্চনা আরো খানিক বসে মাসির সঙ্গে গল্প করত হয়তো, কিন্তু তাকে দেখেই সুখেন্দু যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। বাবা গাড়ি নিয়ে যেতে বলায় মাথা নেড়েছে, গাড়ির দরকার নেই, হাঁটবে একটু
ও-পাশে ধার ঘেঁষে বসে আছে। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে অর্চনা বারকতক জিজ্ঞাসা করেও কি হয়েছে জবাব পায়নি। এখনো চুপচাপ রাস্তার দিকেই চেয়ে আছে। খানিক অপেক্ষা করে আবারও সেই এক কথাই জিজ্ঞাসা করল, এরই মধ্যে কি হল? অ্যাঁ?
গম্ভীর মুখে সুখেন্দু একবার তার দিকে ফিরে তাকাল শুধু!
কথা বলছ না কেন? বলবে তো কি হয়েছে?
কিছু না।
কাছে সরে এসে অর্চনা হাত ধরে নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করল তাকে। –বা রে! কিছু না বললে আমি বুঝব কি করে? সেই থেকে ভাবছ কি?
সুখেন্দু ঘুরেই বসল। বলল, ভাবছি আমার মত এমন একজন গরীব মাস্টারের হাতে তোমার মা তোমাকে কেন দিলেন?
ঠাট্টার সময় হলে অর্চনা ফিরে বলত, মা দিতে যাবে কেন–। কিন্তু এখন হতভম্ব। –তার মানে…মা কিছু বলেছে?
যা বলেছেন তার অর্থ এই দাঁড়ায়। রাগ আর ক্ষোভে গলার চাপা স্বর ব্যঙ্গের মত শোনাল।–আমি শিগগিরই ভাইস-প্রিন্সিপাল হব, থিসিস লিখছি, বিলেত যাব, ফিরে এসে প্রিন্সিপালও হব–তোমার মায়ের মুখে এসব শুনে তোমার মাসিমা মেসোমশাই অবশ্য খুশী হয়েছেন।
এবারে গোটা ব্যাপারটা অনুমান করা গেল। খানিক চুপ করে থেকে অর্চনা বিব্রত মুখে হাসতেই চেষ্টা করল একটু।-তুমি এভাবে নিচ্ছ কেন, আপনজনের আশাও তো করে…
এ-রকম আশা তুমিও করো বোধ হয়?
হঠাৎ উষ্ণ হয়ে সুখেন্দু ঘুরে বসল আরো একটু, আশা করে কি না তাই যেন দেখল। অর্চনা নিরুত্তর।
এর নাম আশা নয়। আমি গরীব মাস্টার, এটা তোমার মায়ের সেই লজ্জা ঢাকার চেষ্টা।
বাড়ির দরজায় গাড়ি থামতে সশব্দে দরজা খুলে নেমে এসে ভাড়া মেটাল। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে হনহন করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল।
অর্চনার নিরুপায় অস্বস্তি আবারও হাসির মত দেখাচ্ছে।
৬. বড় ক্ষতও আপনি শুকোয়
০৬.
অনুকুল অবকাশে অনেক বড় ক্ষতও আপনি শুকোয়। এই ছোট ব্যাপারটা দুদিনেই মিটে যাবার কথা। যেতও হয়তো। সুখেন্দুব রাগ আর জেদ বেশি, দুদিনের জায়গায় না-হয় দশদিন লাগত। কিন্তু কাঁচা ক্ষতর ওপর বার বার ঘষা পড়লে ছোট ব্যাপারও দুষিয়ে বিষিয়ে বিষম হয়ে ওঠে। মেয়ের সংসারটিকে যুগের আলো-বাতাসে টেনে ভোলার শুভ তাড়নায় মিসেস বাসু প্রায় নির্মম। মেয়ে একটা ভুল করে ফেলেছে বলেই তার সংসারযাত্রা সুনির্বিঘ্ন করে দেওয়ার দায়িত্ব যেন আরো বেশি। এই দায়িত্ব পালনের চেষ্টাটা আর একদিকে কেমন লাগছে সেটা তিনি বুঝলেন না বা বুঝতে চেষ্টাও করলেন না।