আমার কাছে!
থাক, তোমার কাছেই থাক–তোমার শাশুড়ীর চাবি। এই এক চাবি দিয়ে হতভাগী এতকাল আমাকে এখানে আটকে রেখেছে–আর কতকাল টানব।
বিগত শ্বশুর বা শাশুড়ীর কথা উঠলেই পিসিমার চোখ ছলছল করে। আজও ব্যতিক্রম হল না। অর্চনা তার আঁচল টেনে নিয়ে চাবির গোছা বেঁধে দিতে দিতে বলল, আপনি কোনকালে ছাড়া পাবেনও না পিসিমা।
পিসিমা খুশী হয়েই হাল ছাড়লেন।
ছোকরা চাকর হবিয়া এসে খবর দিল, দাদাবাবু কাপড় মাঙছেন। পিসিমা তাড়া দিলেন, যাও, কি চাই দেখে এসো।
ঘরে ঢুকে অর্চনা আলমারি খুলে জামা-কাপড় বার করতে গেল। সুখে ইচ্ছে করেই অন্যদিকে ফিরে বসে আছে। জিজ্ঞাসা করল, পিসিমা কি বলছিলেন?
একটা জামা টেনে বার করতে করতে অর্চনা আলতো জবাব দিল, বলছিলেন, তুমি এক নম্বরের গোঁয়ার।
কেন?
আরো আগে বিয়ে করোনি কেন?
সুখেন্দু ফিরে ওকেই দোষী করল, আরো আগে তুমি আসনি কেন?
কেন, আমি ছাড়া কি আর–
হাসিমুখে কথাটা শেষ করবার আগেই জামাটার ওপর ভাল করে চোখ পড়তে থেমে গিয়ে ভুরু কোচকালো। মোটা জামা কালচে দেখাচ্ছে কাপড়টাও সেই রকমই। আরো দুই একটা নাড়াচাড়া করে দেখল একই অবস্থা। বিরক্ত হয়ে, যা বার করেছিল তাই নিয়ে সুখের সামনে রাখল সে।–আচ্ছা প্যান্ট কোট পরে কলেজ না করতে পার নাই করলে, তা বলে জামা কাপড়ের এই ছিরি!
কি হল…? সুখেন্দু তার দিকে ফিরল এবার।
আজই বিকেলে বেরিয়ে–ও কি!…অর্চনা বিষম অবাক।
সুখেন্দু নিরীহ মুখে জিজ্ঞাসা করল, কি?
কি! নাকের নিচে কালির মত এক পোঁচ, এই জন্যেই ক’দিন– আবার হাসছে? কি টেস্ট গো তোমার! পিসিমা ঠিক বলেন, তুমি গোঁয়ার গোবিন্দ!
কাপড়টা টেনে নিয়ে সুখেন্দু হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল।–ওই জন্যেই তো তোমার এত পছন্দ।
অর্চনা আর পারে না যেন।–না সত্যি, তুমি আমার কোন কথা শোন না।
কাপড় পরা শেষ করে সুখেন্দু জামাটা টেনে নিল।–সব কথা শুনি, বলে দেখো।
রাগ ভুলে অর্চনার দরকারী কথাটাই মনে পড়েছে, মায়ের চিঠির কথাই বলা হয়নি এখনো। সুযোগ পেল।–সত্যি?
জামা গায়ে গলিয়ে সুখেন্দু মাথা নাড়ল।
অর্চনা এগিয়ে গিয়ে নিজের হাতে জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে আবারও বলল, ঠিক?
এবার একটু ভয়ে ভয়েই মাথা নাড়ল সুখেন্দু।
কলেজ থেকে ফিরছ ক’টায়?
সাতটায়–
ভাল হবে না বলছি, ক’টা পর্যন্ত ক্লাস?
কেন?
জবাব না দিয়ে অর্চনা ড্রেসিং টেবিল থেকে মায়ের চিঠিটা এনে তার হাতে দিল। চিঠি পড়ে সুখেন্দু বড় নিশ্বাস ছাড়ল একটা।–তাই হবে।
কিন্তু তাই হলেও ঠিক সময়ে হয়নি। সুখেন্দুর গড়িমসিতে এমনি দেরি হয়েছিল একটু, তার পর তৈরি হবার আগেই বাড়িতে সস্ত্রীক তার এক বন্ধু এসে হাজির। তাদের আদর-অভ্যর্থনায় কম করে ঘণ্টাখানেক গেছে আরো। ওরা যখন বেরুলো, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। ট্যাক্সিতে উঠে অর্চনা শুধু বলল, মা দেবে’খন চলো–
সুখেন্দুর ছদ্ম ত্ৰাস, তাহলে এখানেই নেমে পড়ি আমি।
অর্চনা মুখে যাই বলুক, সত্যিই উতলা হয়নি। কিন্তু ওদিকে মা-টি তার যথার্থই রাগে জ্বলছিলেন। বোনের আড়ালে এরই মধ্যে বরকতক তার স্বামীকে ঠেস দেওয়া হয়ে গেছে। মেয়ে-জামাইয়ের আসতে দেরি হচ্ছে বলে ভদ্রলোকটিই দায়ী যেন। শেষে সন্ধ্যাও পেরুতে দেখে হাল ছাড়লেন। ফলে মেজাজ আরো চড়ল। ঘরে এসে শেষদা ফেটে পড়লেন তিনি-আমি বলছি ‘ও-মেয়ের কপালে সুখ নেই। অত করে লিখলাম, তোর মাসিমা মেসোমশাই দুদিনের জন্যে এসেছে, জামাইকে নিয়ে একবার দেখা করে যা–আসতে পারল? আসবে কি করে মেয়ের কি কোন স্বাধীনতা আছে, সেখানে তো পিসিই সব।
ডক্টর বাসু স্ত্রীকে ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করলেন, হয়তো কোন কাজে আটকে গেছে, আজ না আসুক কাল সকালেই আসবে।
গৃহিণীর রাগ এতে বাড়ল বই কমল না!–তুমি তো সবই বোঝে–এই পিসিই ওকে আসতে দেয়নি, নইলে আমি ডাকলেও আসে না। মেয়েটাকে তুমি হাত-পা বেঁধে জলে ফেলেছ
ক্রুদ্ধমুখে গজগজ করতে করতে নিচে নেমে মুখের ভাব বদলে বোন আর ভগ্নীপতি সন্নিধানে এলেন। বোনটি পান চিবুচ্ছেন আর বরুণা এবং রাণুদেবীর সঙ্গে গল্পসল্প করছেন। ভগ্নীপতি ঈজিচেয়ারে লম্বা হয়ে একের পর এক সিগারেট টানছে। মিসেস বাসু ঘরোয়া খোঁজখবর নিতে বললেন, ভগ্নীপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়ে-জামাই তাহলে কিছুকাল এখন আমেরিকাতেই থাকবে।
হ্যাঁ…তা আরো বছর খানেক তো বটেই।
জামাইয়ের কথা উঠতে বোন দিদির দিকে ফিরলেন। ওদিকে ওপর থেকে ডক্টর বাসুও নেমে এসে বসলেন একটু। তাকে দেশে একে একে মেয়ে বউ দুজনেই উঠে গেল। দিদির আশায় এতক্ষণ ধরে বসে বসে আর মাসিমার তত্ত্বকথা শুনে শুনে বরুণার হাঁপ ধরে গেছে। রাণুদেবীর আশা, নিরিবিলিতে সদ্য-আন। উপন্যাসখানা এবারে একটু উল্টেপাল্টে দেখার সুযোগ হবে।
জামাই প্রসঙ্গেই কথা চলল। বোনের দিকে চেয়ে মিসেস বাসু বললেন, তা তুই খরচও যেমন করেছিস, জামাইও তেমনি পেয়েছিস–এ আর ক’জন পারে।
শেষের খোঁচাটুকু স্বামীর উদ্দেশে। কারো কথায় খুশী হলে ফিরে আবার খুশী করারও একটু দায়িত্ব থাকে বোধহয়। বোন ফিরে প্রশংসা করলেন, তুমিই বা খারাপ কি এনেছ দিদি, কতবড় স্কলার হীরের টুকরো ছেলে। বেশ বিয়ে দিয়েছ।
ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলাও চলে না, আবার স্বামীর সামনে বসে এই প্রশংসা …হজম করাও সহজ নয়। মিসেস বাসু দ্ব্যর্থক উক্তি নিক্ষেপ করলেন।আমি কিছু করিনি রে ভাই, ওঁর সঙ্গে আগে থাকতেই ছেলেটির জানাশোনা ছিল, পাকে চক্রে হয়ে গেল। যা করার তোর ভগ্নীপতিই করেছেন