অর্চনার পড়া ছাড়াটা ডক্টর বাসুও ঠিক পছন্দ করেননি। বলেছেন, পড়াটা ছাড়লি কেন, ওঁরা আপত্তি করেন?
অর্চনা তাড়াতাড়ি বলেছে, না বাবা, ওঁদের তো পড়ছি নে বলেই রাগ দেখি সামনের বছরে যদি হয়।
গৃহিণী তাকে অন্য কথা শুনিয়েছেন।–পড়বে কি করে, তার থেকে পাঁচালী আর ব্রতকথা শুনলে কাজ হয় না!
কেমন ঘরে মেয়ে পড়েছে স্ত্রীর সেই অভিযোগ বাবাকে ওর বিয়ের পর থেকেই শুনতে হচ্ছে। কিন্তু তিনি বড় গায়ে মাখেননি বা চিন্তিত হননি। নিজের সূক্ষ্ম দৃষ্টির ওপর ভদ্রলোকের আস্থা আছে। মেয়ের ব্যাপারে স্ত্রী অভিযোগ করতে এলেই একদিনের পরিপূর্ণতার একটা মূর্তি ভাসে তার সামনে। সেটাই তিনি বিশ্বাস করে খুশী আর নিশ্চিন্ত। সুখেন্দুর বন্ধু-বান্ধব ওদের বিয়ে উপলক্ষেই ছোটখাটো একটা আয়োজন করেছিল। সেখান থেকে সুখেন্দুকে নিয়ে অর্চনা এখানে এসেছিল। এ কদিনের মধ্যে ভদ্রলোক নিরিবিলিতে দুটো কথা বলার সুযোগ পাননি। সুখেন্দুকে বরুণা আটকেছে, অর্চনা সোজা বাবার ঘরে চলে এসেছিল। তার গলায় সুখেন্দুর বন্ধুদের দেওয়া মোটা ফুলের মালা, হাতে ফুলের বালা আর রজনীগন্ধার ঝড়।
প্রণাম করে উঠতেই ডক্টর বাসু তার দিকে চেয়ে মহা খুশী।-বাঃ! কোথাও পেছলি বুঝি?
অর্চনা জানাল কোথা থেকে আসছে।
বিয়ের পর ডক্টর বাসু সেই প্রথম যেন ওকে ভাল করে দেখছেন। তৃপ্তিতে দু-চোখ ভরে গেছে তাঁর। ওকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, বেশ, তুই কেমন আছিস বল।
অৰ্চনা মাথা নেড়েছে, অর্থাৎ ভাল।
খুব ভাল?
মায়ের কারণে বাবার ভিতরে ভিতরে সংশয় একটু থাকাই স্বাভাবিক। অর্চনা এবারে আরো বেশি মাথা হেলিয়ে হেসে ফেলেছিল।
সেই থেকে ডক্টর বাসু একেবারে নিশ্চিন্ত।
কিন্তু মাকেও একটু খুশী করতে গিয়ে অর্চনা মাঝে মাঝে দু-নৌকোয় পা দিতে লাগল। এ বাড়িতে এলে সাজগোজ চালচলন আদব-কায়দা আর একটু বাড়ে। একটু আধটু রঙ-চঙ মেখে মায়ের সঙ্গে কালচারাল অনুষ্ঠানেও যোগ দেয় আগের থেকে বেশি। অর্থাৎ মাকে সে বোঝাতে চায়, তার স্বাধীনতা একটুও খর্ব হয়নি বা নিজেও একটুও বদলায়নি। আর তাই দেখে সুখেন্দুরই খটকা লাগত একটু আধটু। বাড়িতে পিসিমার সামনে যে অর্চনাকে দেখে, নিজের মায়ের সামনে সে ইএকেবারে বিপরীত। এই নিয়ে অনেকদিন ঠাট্টা-বিদ্রূপও করেছে। অর্চনা জবাব দিয়েছে, যেখানে যেমন রীতি, তুমি যদি আর এক রকম চাও, আর এক রকমও হতে পারে।
ক’টা মাসের এই একটানা ছন্দে ছোটখাটো একটা তালভঙ্গ হয়ে গেল সেদিন।
দিনের শুরুটা কিন্তু অন্যরকম হয়েছিল। অবসর সময়ে শেভ করার পর নাকের নিচের একটুখানি গুম্ফরেখা তদারকের অভ্যাস সুখেন্দুর অনেক দিনের। আর সেই নিবিষ্টতায় সময়ও একেবারে কম কাটত না। অর্চনা পিছনে লেগে লেগে সেই তোয়াজের গুম্ফরেখা নির্মূল করিয়েছিল। এরই মধ্যে একদিন দিদির কড়া শাসন প্রসঙ্গে এই নিয়ে বরুপার ঠাট্টার জবাবে দুজনকেই জব্দ করার জন্য সুখেন্দু ক’টা দিন নাকের নিচে ব্লেড ছোঁয়ায়নি। অর্চনাকে বলেছে, ফুসকুড়ির মত কি একটা উঠেছে, কাটতে গেলে লাগবে। কটা দিন ছুটির পর আজ কলেজ। একটু তাড়াতাড়িই চান খাওয়া-দাওয়া সেরে এসে ধীরেসুস্থে সে আগের মতই গু-বিন্যাস সম্পন্ন করে নিল। অর্চনা এ-সময়টা পিসিমার কাছে। কলেজের সময় হলে তার ডাক পড়বে জানে। সুখেন্দুর সংকল্প, কলেজ থেকে ফোনে বরুণাকে কোন একটা কারণ দেখিয়ে বিকেলে বাড়ি আসতে বলবে।
কিন্তু সেই দিনই শাশুড়ীর যে একটা জোর তলব এসে আছে সেটা তখনো জানত না। সে তখন চানের ঘরে ছিল, ড্রাইভার অর্চনার হাতে মায়ের চিঠি দিয়ে গেছে। মর্ম, গত সন্ধ্যায় ভাগলপুর থেকে তার মাসিমা আর মেসোমশাই এসেছেন, আগামী কালই আবার চলে যাবেন–মেয়ে-জামাইকে দেখতে চান। অবশ্য যেন বিকেলে তারা আসে, তার ওখানেই বিকেলে চায়ের ব্যবস্থা।
জামাইয়ের ডাক পড়লেই অর্চনা বিব্রত বোধ করে একটু। কারণ খুব স্বেচ্ছায় সে ওখানে যেতে চায় না। তার জন্য বেশ সাধ্য-সাধনা করতে হয়। তাছাড়া, মা-ও অনেক সময় আভাসে ইঙ্গিতে এমন কিছুই বলে বসে যা আরো বিসদৃশ। যাই হোক, মাসিমা মেসোমশাই এসেছেন, না গেলেও নয়। বছর খানেক আগে এই মাসিরই ঘটা করে মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তার মেয়ে-জামাই এখন আমেরিকায় না কোথায়। কথায় কথায় মাসিমার জামাইয়ের গর্ব দেখে অর্চনা বরুণা একসময় অনেক হাসাহাসি করেছে।
চিঠিটা ড্রেসিং টেবিলে চাপা দিয়ে বারান্দার কোণে বসে অর্চনা থালায় ছড়ানো চালের কাঁকর বাছছিল আর পিসিমার কথা শুনছিল। কুলোয় চালের কুঁড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে পিসিমা সুখেন্দুর ছেলেবেলার দাপটের কথা শেষ করে এই চা বাছার প্রসঙ্গে এসে থামলেন।–ছেলের রাগ তো জান না, দুটোর বেশি তিনটে কাঁকর দাতে পড়ল কি উঠে চলল ভাত ফেলে–আমি এক এক সময় না বলে পারি নে, এত রাগ তোর, তুই ছেলে পড়াস কি করে?
অর্চনা শুনছিল আর মুখ টিপে হাসছিল।
সাবি রাঁধুনী একগোছা চাবি ঝন করে সামনে ফেলে দিয়ে গেল, ভাঁড়ারের চাবি নিচে ফেলে এসেছিলে
আর আমার মনেও থাকে না বাপু অত, চাবিটা তোলো তো বউমা, যেভাবে ফেলে গেল যেন গায়েই লাগে না–
থেমে দুই এক মুহূর্ত কি-একটু ভেবে নিলেন তিনি। তার পর বললেন, আচ্ছা, ওটা এখন থেকে তোমার কাছেই রাখো বউমা–খুব যত্ন করে রাখবে।