তার ওপর সেদিন শূন্য-মোড়ার উদ্দেশে স্বামীকে বক্তৃতা করতে শুনে মেজাজ যথাথই বিগড়ালো। মেয়েটা উঠে পালিয়েছে সে-খেয়াল পর্যন্ত নেই। চোখের ওপর হাত রেখে তত্ত্বকথা শোনাচ্ছেন বিড়বিড় করে। একটা হেস্তনেস্ত করার। জন্যেই যেন মিসেস বাসু মোড়ার ওপর এসে বসলেন। লোকে এর পর পাগল ভাববে না তো কি?
এক ঘায়েই তত্ত্বের সব জাল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। চোখ থেকে হাত নামিয়ে ডক্টর বায় মোড়ার ওপর কন্যার বদলে স্ত্রীকে দেখে অপ্রস্তুত।–অর্চনা গেল কোথায়…
মিসেস বাসু ঝাঁজিয়ে উঠলেন, কোথাও যায়নি, নিজের ঘরে বসেই তোমার সেই আদরের মাস্টারের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে–এখন বোকে মেয়ের মতিগতি।
মেয়ের মতিগতি বোঝার বদলে মানুষটা যেন পিত্তি জ্বালিয়ে দিলেন। হৃষ্টকণ্ঠে বললেন, ও, সুখেন্দু এসেছে বুঝি…ওদের এখানে আসতে বলো না?
মিসেস বাসু গম্ভীর মুখে তার দিকে খানিক চেয়ে থেকে রাগ সামলাতে চেষ্টা করলেন প্রথম খুব আনন্দ, কেমন? চোখ দুটো আছে, না নোট লিখে লিখে তাও গেছে?
ভদ্রলোক এবারে বুঝলেন সমাচার কুশল নয়। তবু হালকা জবাব দিলেন, নোট তো তোমার তাগিদেই লিখি। কি হয়েছে?
এইটুকুরই অপেক্ষা। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলেন, কি হয়েছে আর কি হচ্ছে সবই আমি বলব–তোমার চোখ নেই? দু-মাস ধরে দেখছি মেয়ে যখন-তখন হট হুট করে বেরিয়ে যায়–য়ুনিভার্সিটি থেকে আসতেও এক-একদিন সন্ধ্যে কোথায় যায় কি করে ভেবে দেখেছ? আজকাল শুধু বাইরে নয়, বাড়িতেও ঘন ঘন ডেকে আনা হচ্ছে আর তাই শুনে উনি আনন্দে আটখানা একেবারে! শুধু তোমার জন্যেই মেয়ের এত সাহস, শুধু তোমার জন্যে!
একদমে এতখানি উদগিরণের পর তিনি হাপাতে লাগলেন।
আর ডক্টর বাসু আচমকা একটা সমস্যার মধ্যে পড়ে যথার্থই বুডুবু খেলেন খানিকক্ষণ। এই ভাবনার কথাটা ভাবা হয়নি বটে। ভাবতে ভাবতে উঠে বসে চুরুট পরানোর উদ্যোগ করলেন তিনি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুরুট আর ধরানো হল না। তার আগেই সমাধান একটা খুঁজে পেলেন। দুই চোখে আবিষ্কারের আনন্দ। চুরুট ভুলে স্ত্রীর দিকে আর একটু ঝুঁকেই বলেন তিনি।–এ তো বেশ ভাল কথা। আমার মনেই হয়নি কথাটা-সুখেন্দু খাসা ছেলে, চমৎকার ছেলে, ওদের যদি বিয়ে হয়… আমি বলব সুখেন্দুকে?
মিসেস বাসু যেন পাগলের প্রস্তাব শুনলেন। প্রথমে হতভম্ব তার পর ক্রুদ্ধ।–মাথা খারাপ নাকি! অ্যাঁ? ওই চারশ টাকা মাইনের কলেজের মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে। তার ওপর কালচার বলতে ‘ক’ নেই, ওই রকম গোঁয়ারে হাবভাব
এই সরস প্রস্তাবটা এভাবে নাকচ হতে দেখে ডক্টর বাসু বিরক্ত হয়ে মাঝখানেই বাধা দিলেন। তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি, ছেলেটা খারাপ কিসে হল। চার শ টাকা মাইনে কম নাকি! ক’টা ছেলে পায়? অমন উপযুক্ত বিদ্বান ছেলে–পরে আরো হবে।
আমার মাথা হবে আর মুণ্ডু হবে। আর পেরে ওঠেন না মিসেস বাসু।– তার চেয়ে মেয়েটার হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়ে এসো।
আর তুমি তোমার কালচার ধুয়ে জল খাও বসে বসে।…রাগের মাথায় ডক্টর বাসু হাতের চুরুট বিছানায় রেখে বিছানা থেকে দেশলাই তুলে জ্বালতে গেলেন। তার পর মুখে চুরুট নেই খেয়াল হতে দেশলাই ফেলে চুরুট তুলে মুখে দিলেন। শেষে দেশলাইয়ের অভাবে চুরুট হাতে নিলেন।-এই তো, তোমার বোন মস্ত বড়লোক দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, ভগ্নীপতির ওদিকে দেনার দায়ে চুল বিক্রি–আমারও সেইরকম অবস্থা হোক, কেমন? কোথা থেকে আনব, কোথা থেকে দেব—
মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। শুধু তাই নয়, এতবড় খোঁচাটা দিয়ে ফেলে তার ফলাফল থেকেও অব্যাহতি পেলেন। সহাস্যে ঘরে আসছে বরুণা, অর্চনা–তাদের সঙ্গে সুখেন্দু। ঢুকে পড়ে সুখেন্দু না বুঝলেও মেয়ে দুটো ঘরের তাপ উপলব্ধি করে একটু থমকেছে।
ডক্টর বাসু সামলে নিয়ে ডাকলেন, এসো সুখেন্দু এসো
স্ত্রীর দিকে চেয়ে অতঃপর কিছু একটা আলোচনারই উপসংহার টানলেন যেন।– ভাল করে ভেবেচিন্তে দেখা দরকার বইকি, তুমি যা বলেছ তাও ঠিক, এক কথার ব্যাপার তো নয়।
বলা নেই কওয়া নেই এইভাবে বাইরের লোক নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢোকার দরুন মিসেস বাসু মেয়ে-দুটোর ওপরেই মনে মনে জ্বললেন একপ্রস্থ। মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কষ্টকৃত আপসের সুরে স্বামীর উপসংহারের ওপর মন্তব্য করলেন, তোমার কথাও মিথ্যে নয়, আমার যা মনে হল তাই বললাম, নইলে এসব ব্যাপার তোমরাই ভাল বোঝে–
বাইরের লোকের সামনে অৰ্চনা-বরুণা বাবা মায়ের এ ধরনের পরোক্ষ অতি-বিনিময় শুনে অভ্যস্ত। তারা যে-যার অন্যদিকে চোখ ফেরাল। ডক্টর বাসু একটু সরে বসে আপ্যায়ন জানালেন, সুখেন্দু দাঁড়িয়ে কেন, বসো–আজ কলেজ নেই? ও আজ ছুটি বুঝি, আমার সবদিনই ছুটি তো, মনেই থাকে না। এতক্ষণের বাক্বিতণ্ডার কারণ ভুলে হেসে উঠলেন তিনি।
মায়ের চোখে চোখ পড়তেই অর্চনার সঙ্কট। তার মুখের ওপর এক ঝলক উগ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি কাজের অছিলায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অর্চনা আর বরুণা এবারে পরস্পরের দিকে চেয়ে হাসি চাপতে চেষ্টা করল। বাবা প্রসন্নমুখে চুরুট ধরাবার উদ্যোগ করছেন।
কটা দিনের মধ্যে ননিমাধবের উদ্যমের বেপরোয়া পরিবর্তন দেখে বিজন পর্যন্ত ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। স্ত্রী দিনরাত নভেলে ডুবে থাকলেও, বাড়িতে যখন থাকে, অন্দরমহলের সমাচার কিছু কিছু কানে আসেই। তার কাছ থেকে যেটুকু খবর পায় তাতেই অনুগত পার্টনারটির জন্য মনে মনে একটু চিন্তিত। অতটা হত না, যদি না ব্যবসায়ে ননিমাধবকে হঠাৎ অমন উৎসাহের বন্যায় ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেখত। এত উৎসাহ আর উদ্যমের উৎস কোথায় সেটা সে ভালই জানে। আর সেখানে কোন প্রতিকূল ছায়া পড়লে সবেতেই যে শুকনো টান ধরে যাবে তাও সহজেই অনুমান করতে পারে।