অর্চনার দৃষ্টি তখন দরজার দিকে। মনে মনে সেও এক খোঁজেই অন্যমনস্ক। কথাটা কানে যেতে অপ্রতিভ মুখে ঘুরে বসল।–হ্যাঁ বাবা, খুজছে…
তাই তো বললাম, কিন্তু কাকে? একটা যেন ধাঁধার পরদা সরাচ্ছেন তিনি, এমনি আগ্রহ।…কার জন্য তার এই আকূতি?
ভ-ভগবানের জন্য? অর্চনার নিরুপায় মনোযোগ।
মেনেই নিলেন যেন। বললেন, বেশ কথা, ধরা যাক ভগবানকেই খুঁজছে। কিন্তু ভগবান কোথায় থাকে?
বিষয়ের গভীরতায় ক্রমশই তলিয়ে যাচ্ছেন ডক্টর বাসু। ভগবানের কোথায় থাকা সম্ভব সেই উপলব্ধি আগে স্পষ্ট হলে পরের আলোচনা। তাঁর বিশ্লেষণ, মানুষ তো সেই কোন কাল থেকে আছে–প্রথমে ছিল অনার্য, তারা মারামারি করত কাটাকাটি করত, হিংসা ছাড়া আর কিছুই জানত না কিন্তু তাদেরও ভগবান ছিল, তাদের সেই ভগবানের মূতি আরো হিংস্র আরো বীভৎস। কিন্তু মানুষ যত সভ্য হতে লাগল, দেখা গেল তাদের ভগবানও আরো সভ্য হচ্ছে আরো সুন্দর হচ্ছে। তাহলে কি বলতে হবে ভগবানও মানুষের মতই আগে অনার্য ছিল শেষে আর্য হল? হেসে উঠলেন তিনি–তা নয়… আসলে আমরা যেমন দেখি। ভগবান বলতে আমরা যাকে ভাবি সে তো তাহলে মানুষেরই প্রতিবিম্বিত মহিমা।
ব্যাখ্যার প্রসন্ন আনন্দে আধ-শোয় অবস্থাতেই একটা চুরুট ধরালেন। অর্চনার ঝিমুনি আসছিল, চুরুটের কড়া গন্ধে চোখ টান করে তাকাল। একমুখ ধোয়া ছেড়ে ডক্টর বাসু চোখ বুজে বিশ্লেষণটুকুই ভাবতে লাগলেন।
দাশু অর্চনার এই বাক্য শোনার কথাই বলেছিল ননিমাধবকে।
বিজন ফিরেছে। আঠারো হাজার টাকার উষ্ণতায় তার উৎসাহ অনেকটাই পুনরুজ্জীবিত। কিন্তু পাছে পার্টনার ঢিলে দেয় সেই আশঙ্কায় টাকা যে কত ব্যাপারে কত কারণে দরকার সেটাই নানাভাবে বেশ করে বোঝাচ্ছে তাকে। ননিমাধব শুনছে। ম্রিয়মাণ। একটু আগে ওই বাইরের বারান্দা দিয়ে হাসি খুশি মুখে বরুণা যে লোকটাকে একেবারে ওপরে নিয়ে গেল–ম্রিয়মাণ তাকে দেখেই।
দেখেছে বিজনও। কিন্তু নিজের আগ্রহে আর উৎসাহে অত খেয়াল করেনি। দেখেছে এই পর্যন্ত। ফ্যাক্টরির ভবিষ্যৎ-চিত্রের সব সমস্যার ফিরিস্তি শেষ করে বলল, এখনই তিরিশ হাজার পেলে ভাল হত হে।
ননিমাধব অন্যমনস্কর মত জবাব দিল, বাকিটাও শিগগিরই পাওয়া যাবে–
ভেরি গুড! চেকটা তুমি বিজনেস একাউন্টে জমা করে দাও, তোমাকে আর কিছু ভাবতে হবে না।
কিন্তু তার মুখের দিকে চেয়ে মনে হল ভাবনা তার একটুও নিরসন হয়নি। আর ভাবনা কিসের তাও যেন বোধগম্য হল এতক্ষণে। বরুণার সঙ্গে একটু আগে যে লোকটা ওপরে উঠে গেছে তার ওপরেই মনে মনে বিরূপ হল একটু। কিছুদিন আগে ননিমাধবের সেই আভাসও মনে পড়ছে। এমন এক সময়ে ওই মেয়ে দুটোর কাণ্ডজ্ঞানহীনতা চক্ষুশূল। ব্যবসায় নেমে কোন আলোচনাতেই কিছুমাত্র সঙ্কোচ নেই। ঝোঁকের মাথায় সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বিনা ভণিতায় পার্টনারকে কিছুটা আশ্বাসই দিয়ে ফেলল সে। গলা খাটো করে বলল, দেখ, একটা কথা শুনে রাখো-ওসব মাস্টার-টাস্টার মা দু’চক্ষে দেখতে পারে না, তোমার কিচ্ছু ভাবনা নেই, বুঝলে?
কিন্তু বুঝেও খুব যেন স্বস্তি বোধ করল না ননিমাধব। তবে প্রসঙ্গটা সুবাঞ্ছিত বটে। শুকনো মুখে একটু হাসল, আমতা আমতা করে বলল, আমি বলছিলাম কি বিজুদা, কথাটা একবার মাসিমার কাছে পেড়ে রাখলে হত না? মা–মা বলছিলেন আর কি…।
তাকে আশ্বাসটা একেবারে মিথ্যে দেয়নি বিজন, অবস্থা ফেরাতে পারলে মায়ের মত পাওয়াই যাবে এটা তার বিশ্বাসই। আর অবিশ্বাসই বা হবে কেন, ননিমাধব ছেলে তো খারাপ নয়। তাছাড়া মেয়ে দুটোর ইয়ারকি ফাজলামো দেখেও মনে হয়েছে কোনদিকে আটকাবে না! তবু নিজেদের জোরে দাঁড়ানোর জোরটাই আগে অভিপ্রেত মনে হয়েছে বিজনের। জবাব দিল, কথা তো পাড়লেই হয়, কিন্তু ব্যবসাটা জাঁকিয়ে দাঁড়াক একটু। মুশকিল কি জানো, তোমাকে তো সেদিন বললাম–আমরা যে কিছু একটা করছি তা এরা বিশ্বাসই করে না। আর করবেই বা কি দেখে, লাভ তো সবই প্রায় ব্যবসাতেই খেয়ে যাচ্ছে, অথচ এখনো তো আমাদের কোম্পানির একটা গাড়ি পর্যন্ত হল না।
ননিমাধব তৎক্ষণাৎ প্রস্তাব দিল, গাড়ি কিনে ফেল।
বিজন অবাক। গাড়ি কিনে ফেলব। এই টাকা থেকে?
না তা কেন, টাকা তো আমি দু-চার দিনের মধ্যেই আনছি–তুমি একটা গাড়ি দেখ।
পার্টনারের এতবড় সহযোগিতায় বিজন যথার্থই বিচলিত এবারে। ওর জন্যে যা বলার মাকে সে বলবে; শুধু বলবে না, রাজীও করাবে। ভারি তো–। একটু চিন্তা করে সম্মতি জ্ঞাপন করল, আচ্ছা…। আর মায়ের সঙ্গেও আমি কথা বলব’খন।
কলেজের মাস্টারের প্রতি মায়ের বিতৃষ্ণা সম্বন্ধে বিজন যথার্থই নিঃসংশয়। কিন্তু মায়ের সঙ্গে কথা বলার আগে কথা যে আর একপ্রস্থ সেই দিনই ওপরেও হয়ে গেল, সেটা জানলে বোধ করি তারও অস্বস্তির কারণ হত।
সেই কথা বলেছেন ডক্টর বাসু নিজে।
তিনি নিজে থেকে বলেননি, বা বলার কথা হয়তো চট করে তার মনেও হত না। সেই বাস্তা করে দিয়েছেন মিসেস বাসু। স্ত্রীর অসহিষ্ণুতা একদিনের দুদিনের নয়। বড় মেয়েটি তার কোন কথার মুখোমুখি অবাধ্য না হলেও তাকে যে সব সময় ইচ্ছেমত আগলে রাখা সহজ নয় মনে মনে এটুকু তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতেন। বাড়িতে যে-একজনের আদৌ শাসন নেই, তার কথাই বরং মেয়েটা শোনে অনেক বেশি। অথচ সেই-একজনেরই প্রশ্রয়ে দিনের পর দিন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে কোথাকার কে একটা প্রাইভেট কলেজের মাস্টার, এটা মায়ের পক্ষে বরদাস্ত করাও খুব সহজ নয়। মেয়েটা না হয় নিজের ভাল মন্দ বোঝে না, কিন্তু এই একটা মানুষেরও একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকতে নেই। এ নিয়ে অনেকদিনই স্বামীকে দু-পাঁচ কথা বলেছেন, কিন্তু যত জ্বালা তারই, মাথায় কিছু ঢোকে কি না সন্দেহ।