ফলে ভবিষ্যৎ রচনার এই নব-উন্মাদনা ননিমাধবের। বিজনকে কথা দিয়েছে, আজ সে চেক নিয়ে আসছে। অবশ্য বাকি টাকাটা কিছুদিন বাদে সংগ্রহ হবে তাও জানিয়েছে। হাতে যা এসেছে তাও কম নয়, বিজন খুশী। টাকা ননিমাধব চেষ্টা করলে সংগ্রহ করতে পারে সেটা তার জানাই আছে। তার ফুরসৎ নেই একটুও, ঘোরাঘুরি করে সব বিধিব্যবস্থা তাকেই করতে হয়।
বাবার কাছ থেকে চেক পেয়েই ননিমাধব সোজা এ-বাড়ি চলে এসেছে। ছুটির দিন, ফ্যাক্টরি বন্ধ। বিজন বাড়ি নেই জেনেও দুঃখিত হয়নি, কিন্তু বাড়িতে যেন আর কেউ নেই। একা বসে বসে বিরক্তি ধরে গেছে। দাশু অবশ্য রাণু বউদিকে খবর দিতে যাচ্ছিল, ননিমাধবই বাধা দিয়েছে, উনি পড়ছেন পড়ন ডাকাডাকি করে বিরক্ত করা কেন!
কিন্তু ছোট দিদিমণিও নাকি পড়ছে আর বড় দিদিমণি বাবুর ঘরে আটকে আছে। ননিমাধব দাশুকে পাঠিয়েছে এক পাকেট সিগারেট আনতে। সে এলে একবার খবর দিতে বলা যেত। কিন্তু দাশু সিগারেট আনতে গেছে তো গেছেই, দুটো গোটা সিগারেট খাওয়া হয়ে গেল ননিমাধবের, নবাবের এখনো দেখা নেই।
বাইরে থেকে গুনগুন একটা গানের শব্দ কানে আসতে ননিমাধব সোজা হয়ে বসল। লঘু চরণে যে আসছে সে বরুণা। মেয়েটা যত ফাজিলই হোক, ওর মন বোঝে।
কিন্তু বরুণার তখন মন বোঝার আগ্রহ একটুও ছিল না। অন্য আগ্রহ নিয়েই সে নীচে এসেছিল একবার। তিনটে নাগাদ যার আসার কথা সে ননিমাধব নয় আর একজন! তিনটে বেজে গেছে, বরুণা নিচের ঘরটা একবার দেখে যেতে এসেছিল। তার বদলে সেখানে ননিমাধবকে দেখে দরজার ওপরেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল সে। তারপর দু হতাশার সুরে বলল, ও আপনি…
ননিমাধব হাসিমুখেই রসিকতা করল, আর কেউ ভেবেছিলে বুঝি?
বরুণা ঘরের মধ্যে দু-পা এগিয়ে এলো। বড় করে নিশ্বাস ফেলল।–হ্যাঁ।
কিন্তু রসিকতার ঠিক মুড নয় ননিমাধবের। কারণ সব ছুটির দিনে আর একজনের আবির্ভাবই তার অনেক আনন্দ পণ্ড করেছে। বলল, ও, ইয়ে–আর কারো আসার কথা আছে বুঝি?
হ্যাঁ।
অগত্যা ননিমাধব হাসতেই চেষ্টা করল।–আমি বিজুদার জন্যে বসে আছি–
বসে থাকুন, এসে যাবে–
বরুণা সরে পড়ার উদ্যোগ করতেই ননিমাধব বাধা দিল, তুমি বোসো না, দাঁড়িয়ে কেন।
ও বাবা, দাদা এসে দেখলেই–
বরুণা ছলনায় সেয়ানা। মুখের ত্রাসে মনে হল দাদা এসে ওকে সরাসরি খুনই করবে। আশঙ্কাটা শেষ না করেই বলল, আপনি বরং বসে বেশ করে ব্যবসার কথা ভাবুন।
তাড়াতাড়ি প্রস্থান করতে গিয়েও থামল একটু। হাত বাড়িয়ে পাখার। রেগুলেটারটা আরো খানিকটা ঘুরিয়ে তরতরিয়ে চলে গেল।
ঈজিচেয়ার ছেড়ে ঘরের মধ্যেই বার দুই চক্কর খেল ননিমাধব। টেবিলের ওপর থেকে শূন্য সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল। হাঁ-করা খালি সেটা। দ্বিগুণ বিরক্তি। ফিরে দেখে দাশু সিগারেট নিয়ে ঘরে এসেছে। তার হাত থেকে সিগারেট আর ফিরতি পয়সা নিয়ে যতটা সম্ভব মেলায়েম করেই জিজ্ঞাসা করল, এত দেরি?
দাশু কৈফিয়ত দিল, দুপুরে কাছের দোকান বন্ধ।
ননিমাধব ঈজিচেয়ারে বসল আবার। পয়সা পকেটে রাখতে গিয়ে কি ভেবে মুখ তুলল। দাঁত ফিরে যাচ্ছিল, ডেকে থামাল। পয়সাগুলো তার দিকে বাড়িয়ে দিল–এ ফেরত দিলে কেন, তুমি রাখো-না, রাখো–
দাশুর নিস্পৃহ পর্যবেক্ষণ।– রাখব?
হ্যাঁ, ধরো–।
দাশু পয়সা নিয়ে ট্যাঁকে গুঁজল এবং আরো কিছু জবাব দিতে হবে বুঝেই প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল।
একটা সিগারেট ধরিয়ে ননিমাধব অন্তরঙ্গ সুরে বলল, আচ্ছ। এ বাড়িতে তো তুমি বহুকাল আছ, না?
সম্ভব হলে দাশুকে একটা সিগারেটও দিত সে, মনিবের চুরুটের বাক্স থেকে তার চুরুট সরানোর অপবাদ ননিমাধব একাধিকবার শুনেছে। কিন্তু অতটা পেরে উঠল না।
দাশু জবাব দিল, হ্যাঁ–বড় দিদিমণির জন্ম থেকেই বলতে পারেন।
তুমি তো তা হলে একেবারে ঘরের লোক হে!…যেন ঘরের লোক বলে তারও বিশেষ আনন্দের কারণ কিছু আছে। একটু থেমে বক্তব্যের দিকে এগোতে চেষ্টা করল আবার।-আচ্ছা দাশু, এই তোমার গিয়ে মাস দুই হল তোমার দিদিমণির দেখাই নেই প্রায়…লেখাপড়া-টড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত বুঝি?
দাশু নিষ্প্রাণগোছের জবাব দিল, হ্যাঁ…ওই নতুন মাস্টারবাবুর সঙ্গে।
মাস্টারবাবু! ও সেই প্রফেসার?…নিজের অগোচরে গুণ্ডা কথাটাই বেরিয়ে যাচ্ছিল মুখ দিয়ে।
দাশু গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ল।
ননিমাধব উঠে গিয়ে সিকি-খাওয়া সিগারেটটাই জানলা দিয়ে ফেলে এলো। ও প্রস্থানোত।
দাশু—
ঘুরে দাঁড়াল।
ইয়ে—তোমার দিদিমণি এখন কি করছেন বলো তো?
ছোড়দিদিমণি?
পারলে ওরই মুণ্ডপাত করে।–না, বড় দিদিমণি।
হাত দিয়ে দোতলায় কোণের ঘর ইঙ্গিত করে দাশু শুদ্ধ ভাষায় জবাব দিল, কর্তাবাবুর বাক্য শুনছেন।
ননিমাধব বিরক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু দাশু খুব মিথ্যে বলেনি।
বাবার ঘরে বসে অর্চনা বাক্যই শুনছিল আর বাবার অগোচরে মাঝে মাঝে দরজার দিকে তাকাচ্ছিল।
বিছানায় একসঙ্গে তিনটে বালিশে মাথা রেখে আধ-শোয় ভাবে অনর্গল কথায় নিজেকেই যেন স্পষ্ট করে দেখছেন ডক্টর বাসু। আর সামনের মোড়ায় বসে অর্চনাকে শুনতে হচ্ছে সেই আত্মদর্শন তত্ত্ব। অনেক সময়েই শুনতে হয়, ফাঁক খুঁজে না পালানো পর্যন্ত রেহাই নেই। কিন্তু ফাঁক আর পেয়ে উঠছে না বাবার বলার ঝোঁকটা ক্রমশ বাড়ছে।
ডক্টর বাসু বইখানা বুকের ওপর রেখে ব্যাখ্যায় তন্ময়। তাঁর বক্তব্য, যে-ভাবেই থাকুক আর যে-কাজই করুক মানুষ, ভিতরে ভিতরে সে খুজছে কাউকে। নিজের অজ্ঞাতে তার খোঁজার বিরাম নেই। ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন, কিন্তু কাকে খুঁজছে?