জবাবে মিসেস বাসু একটা উগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রস্থান করেছেন।
ডক্টর বাসু জানতেন না, ড্রাইভারকে পাঠিয়ে নয়, সকলের অগোচরে ড্রাই ভারকে নিয়ে একজন খবর করতেই গেছে। একজন নয়, দুজন। বরুণাও গেছে। শুধু তাই নয়, বরুণাই ইন্ধন যুগিয়ে নিয়ে গেছে তার দিদিকে। সব শুনে আসল ফুতিটা তারই হয়েছিল। এমন কাণ্ডটা নিজের চোখে দেখা হল না বলে আপসোসেরও শেষ নেই। এর আগে বাস-স্টপ থেকে দিদির সেই লোকটাকে গাড়িতে তলে নেওয়ার সমাচার শুনেও বোধ হয় এত আনন্দ আর নিজের অনুপস্থিতির দরুন এত দুঃখ হয়নি। আগের সেই খবর শুনে সেও লোকটার জন্য উৎসুকভাবে দিনকতক প্রতীক্ষা করেছিল। আসেনি দেখে দিদিকে জ্বালাতেও ছাড়েনি। বলেছে, এমন রসকষশূন্য লোকের বাসে পাশে বসা কেন? আর তুই বা কোন্ মুখে তাকে সেধে গাড়িতে এনে তুললি আর বাড়ি আসার জন্যে সাধলি? বেশ হয়েছে, খুব জব্দ।
কিন্তু এবারে আর ঔৎসুক্য চাপতে পারেনি। বার বার পরামর্শ দিয়েছে, নিশ্চয় বিছানায় পড়েছে, চল না একবারটি দেখে আসি, কাছেই তো–
অর্চনা ভ্রূকুটি করেছে, বিছানায় পড়ে থাকলে কি করবি, সেবা করবি?
সেবা করতে হবে না, তোক দেখলেই বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠবে। চল না, খেয়ে ফেলবে না!
বাড়ি কাছে হলেও একেবারে কাছে না। তবে মোটরে সামান্য সময়ই লাগল। লক্ষ্যের কাছাকাছি এসে বরুণাই আবার নিরুদ্যম একটু। একটা বিষয় মনে ছিল না, এখন মনে পড়েছে। তাই চুপ করেও থাকতে পারেনি। ভদ্রলোক আবার প্রফেসর যে রে…আমি আই. এ. পড়ি জানে?
বেরিয়ে পড়ে অর্চনার সঙ্কোচ গেছে। জবাব দিল, খুব জানে, মোটরে বসে সেদিন সারাক্ষণ তোর কথাই তো জিজ্ঞাসা করছিল–তোদের কলেজেই আবার মাস্টারির চেষ্টা করছে এখন।
রাস্তার ওপর ছোট বাড়িটা খুঁজতে হল না। দরজার গায়ে লেটার বক্স-এ নাম আর নম্বর লেখা। অর্চনার নির্দেশে ড্রাইভার নেমে গিয়ে কড়া নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যে বাইরে এল, সে স্বয়ং সুখেন্দু মিত্ৰই। খুব সম্ভব বেরুচ্ছিল।
গাড়িতে আরোহিণী দুজনকে দেখে অবাক। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল।
অর্চনা নেমে দাঁড়াল। লোকটা সুস্থ শরীরে নিজেই হাজির দেখে তারও বিসদৃশ লাগছে একটু।
আপনি…
অর্চনা হাসিমুখে বলল, দেখতে এলাম, বাড়িতে তো তিনদিন ধরে হ্যাঁচ্চা ম্যাচ্চো চলছে–আপনি কেমন আছেন?
কেন!…প্রথমে হঠাৎ বুঝে ওঠেনি। তার পরেই মনে পড়তে হেসে উঠল।… ও, সেদিনের সেই জলে ওঁদের শরীর খারাপ হয়েছে বুঝি?
রীতিমত। আপনি ভাল আছেন তো একবারও গেলেন না কেন? বাবা ওদিকে ভেবে অস্থির, ভাবছেন, আপনারও ভাল রকম কিছু হয়েছে
সুখেন্দু হাসতে লাগল। –না, আমি ভাল আছি। ভিতরে ডেকে বসতে বলবে কি না ভাবছে। এ-রকম অতিথি আপ্যায়নের বৈচিত্র্যে পড়তে হয়নি। কখনো। পিসিমার পর্যন্ত গঙ্গাস্নান সেরে ফেরার নাম নেই। আর সে যাচ্ছিল চা ফুরিয়েছে চা কিনতে–অতএব একটু চা-ও দেওয়া যাবে না। কিংবা এদের বসিয়ে আবার চা আনতে যেতে হবে। কিন্তু না-ডাকাটা নিতান্ত অভদ্রতা। বরুণ এবং অর্চনা দুজনের উদ্দেশে বলল, ভিতরে এসে বসুন, পিসিমা অবশ্য বাড়ি নেই, এক্ষুনি এসে পড়বেন।
বোঝা গেল বাড়ির কর্ত্রী পিসিমা এবং তিনি ছাড়া ওদের সঙ্গে কইতে পারে এমন আর কেউ নেই। পিসিমা থাকুন আর নাই থাকুন অর্চনা সরাসরি বাড়ি গিয়ে ঢুকতে রাজী নয়। তাড়াতাড়ি বাধা দিল, না আমরা এমনি একবার দেখতে এলাম, বাড়িতে হয়তো এতক্ষণ খুঁজছে আমাদের। থামল একটু, আপনি বেরুচ্ছেন কোথাও? ফাঁক পেয়ে হাসিমুখে সত্যি কথাটাই বলে দিল সুখেন্দু মিত্র, আমার চা শেষ, চা আনতে যাচ্ছিলাম।
তাহলে আপনিই চলুন না আমাদের বাড়ি, বাবা খুব খুশী হবেন–
আপত্তি নেই সেটা মুখ দেখেই বোঝা গেল। ভিতরের কারো উদ্দেশে দরজা বন্ধ করতে বলে গাড়ির সামনের আসনে বসতে গেল সে।
অর্চনা বাধা দিল, আপনি পিছনে বসুন, আমি সামনে বসছি—
ঠিক আছে। দরজা খুলে সুখেন্দু ড্রাইভারের পাশে বসে পড়ল।
গাড়ি বাড়ির পথ ধরতে হাসি চেপে অৰ্চনা বরুণার দিকে তাকাল। বরুণ যতটা সম্ভব নির্বিকার মুখে রাস্তা দেখছে। আর দিদিটা যে ওর থেকেও অনেক বেশি মানুষ হয়ে গেছে, গম্ভীর পুলকে মনে মনে তাই ভাবছে। সামনের দিকে চোখ ফিরিয়ে অর্চনা জিজ্ঞাসা করল, একে চেনেন?
সুখেন্দু মিত্র ঘুরে বসল একটু। তার পর বরুণাকে দেখে নিয়ে বলল, আপনার বোন?
হ্যাঁ, বরুণা। আপনি কলেজের প্রফেসর আর ও মোটে আই. এ. পড়ে, বড় লজ্জায় পড়ে গেছে।
সুখেন্দু হেসে উঠল। সে সামনের দিকে চোখ ফেরাতেই বরুণার রামচিমটি। অর্চনা একটা কাতরোক্তি করে ছদ্ম কোপে জোরেই ধমকে উঠল তাকে, এই। লাগে না?
৪. ঘরের ইজিচেয়ারে ননিমাধব
০৪.
নিচের ঘরের ইজিচেয়ারে ননিমাধব চিৎপাত হয়ে প্রায় শুয়েই আছে আর ভাবছে। ভাবছে, ছুটির দিনের দুপুরগুলি এমন নীরস কাটত না। এই বাড়ির তলায় তলায় বেশ একটা পরিবর্তনের ধারা বইছে। সেটা ঠিক প্রত্যক্ষগম্য না হলেও অনুভব করা যায়। ননিমাধব অনুভব করছে।
আজও আপাতদৃষ্টিতে বিজনের জন্যেই অপেক্ষা করছে সে। আর তার আজকের প্রতীক্ষার মধ্যে বেশ জোরও ছিল একটু। পকেটে বাবার দেওয়া আঠারো হাজার টাকার চেকটা করকর করছে। দু-মাস আগেকার সেই প্ল্যানের রসদ বার করতে এতটা সময় লেগে গেল। তাও বাবা তিরিশ হাজার দেননি, বলেছেন, কাজ এগোক আস্তে আস্তে দেবেন। বিজনের ধারণা, পার্টনার যতটা তৎপর হলে সব সমস্যা সহজে মিটে যেতে পারে, ততটা তৎপর সে নয়। ধারণাটা খুব মিথ্যেও নয়। তাদের বিজনেস এক্সটেনশানের প্ল্যানের এই টাকাটাও বার করে আনতে আরো কতদিন লাগত বলা যায় না। আর আনা যে গেছে সেটা শুধু বিজনের অসহিষ্ণুতার ভয়েই নয়। পায়ের নিচে আজকাল নিরাপদ মাটির অভাব বোধ করছিল ননিমাধব। অলক্ষ্য থেকে আর কেউ যেন সেই মাটিতে পা ফেলে চলেছে। ননিমাধবের উদ্যম আর বাবার সঙ্গে ফয়সালা করে টাকা নিয়ে আসার আগ্রহের পিছনে বড় কারণ সম্ভবত এটাই। বিজুদাকে একটু শান্ত না করতে পারলে আর কোন সমস্যা তার মাথায় ঢোকানো যাবে না। আভাসে ইঙ্গিতে একটু আধটু চেষ্টা করেছিল, বিজন কি বুঝেছে সে-ই জানে, ওর সমস্যার ধার-কাছ দিয়েও যায়নি। উল্টে বলেছে, দেখ, এই ব্যবসা দাঁড় করানো ছাড়া এখন আর কিছু ভেবো না-মা তো এখনো ভাবে তোমাতে আমাতে ছেলেমানুষিই করছি একটা।