ডক্টর বাসু হৃষ্টচিত্তে সামনের দুজনের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন! জলে পড়ার লজ্জা বা দুর্ভাবনা তার তেমন নেই। আমার ছেলে বিজন, আর ও ননিমাধব, আমাদের আত্মীয়ের মতই–দুজনে জয়েন্টলি সাইকেল-রিকশর ব্যবসা করছে।
বিজনের মনে হল, বাবা যেভাবে বললেন কথাটা যেন হাস্যকর কিছুই করছে ‘তারা। প্রতিনমস্কারের হাত তুলল কি তুলল না। সামনের দিকে ফিরে এতক্ষণে সেও বিষম বিরক্তি সহকারে মন্তব্য করল, ড্রাইভারটা একটা আস্ত ইডিয়ট।
ননিমাধব অবশ্য হাত তুলেছে, নমস্কার করেছে, আর ডক্টর বাসুর হাস্যোক্তির সঙ্গে সঙ্গে হেসেছেও। তার পর ভাল করে লোকটাকে নিরীক্ষণ করেছে।
ডক্টর বাসু একদা-স্নেহভাজন লোকটির খোঁজখবর নিতে ব্যস্ত।–হ্যাঁ, কি করছ সুখেন্দু তুমি আজকাল?
এবার অর্চনাই স্মরণ করিয়ে দিল, বাঃ, সেদিন বললাম না তোমাকে!
মনে পড়ল।–ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেছিলি। তুমিও মাস্টারি করছ। কোন্ কলেজে?–বেশ বেশ, তুমিও এই রাস্তাই নিলে শেষ পর্যন্ত–ভাল করোনি, মাস্টাররা আজকাল নো-বডির দলে।
আনন্দ দেখে অর্চনাই শুধু বুঝল, মাস্টারি করছে শুনেই বাবা সব থেকে খুশী। আর মাস্টার ছাড়া অন্য সকলকেই যে নিজে তিনি নো-বডি মনে করেন সেটাও ভালই জানে। কিন্তু মায়ের জন্যই অর্চনা স্বস্তিবোধ করছে না, কথাবার্তা না বলে প্রায় চুপ করেই আছে। লোকটি হাসিমুখে বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে দেখেও, এতদিনে একবার বাড়ি না আসার অনুযোগটা করে ওঠা গেল না।
একে দেখে বাবা এতটা খুশী হবেন তা ও ভাবেনি। তিনি খোঁজখবর নিচ্ছেন তখনো–এদিকেই থাকো বুঝি? এই কাছে? কোথায়? কত নম্বর বাড়ি বলো তো?
যেন নিজেই তিনি যাবেন একবার দেখা করতে। ননিমাধব তখনো ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে এদিকে। অর্চনার চোখেও চোখ পড়ছে, অর্চনা নিরীহ মুখে চেষ্টা করছে যাতে না পড়ে।
মা আর দাদার নীরব ধৈর্যচ্যুতির শেষ অবস্থায় দেখা গেল ড্রাইভার গাড়ি ঠেলার জন্য দুটো লোক এনে হাজির করেছে। ড্রাইভার স্টিয়ারিংএ বসল, লোকদুটো পিছনে ঠেলতে গেল। ডক্টর বাসু সুখেন্দুকে বললেন, বড় খুশী হলাম, একদিন এসো কিন্তু আমাদের বাড়ি, ঠিক এসো–
কিন্তু এই জল-লীলার শেষ দৃশ্যটি বাকি তখনো।
গাড়ির দু-হাতও নড়ার ইচ্ছে দেখা গেল না। একে গাড়িটা নেহাত ছোট নয়, তার ওপর ড্রাইভার নিয়ে ভিতরে ছ-জন লোক বসে। বার দুই চেষ্টা করেই পিছনের লোকদুটো হাল ছাড়ল। সুখেন্দু দাঁড়িয়ে দেখছিল, হাত গোটাতে গোটাতে বিজন আর ননিমাধবের উদ্দেশে বলল, দুজনে হবে কেন, আসুন আমরাও একটু ঠেলে দিই–
প্রস্তাব শুনে গাড়ির সকলেই হকচকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। শুধু ডক্টর বাসু ছাড়া। তিনি সানন্দে বিস্ময় প্রকাশ করলেন, তুমি–তোমরা! হা-হা করে হেসে উঠলেন তার পরেই, ছেলেকে বললেন, যা না-ব্যবসা তো খুব করিস, গায়ে কেমন জোর আছে দেখি–
অর্চনার মজা লাগছে। কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রায় শঙ্কিত। নিরুপায় বিরক্তিতে বিজন গাড়ি থেকে জলে নামল। ননিমাধব নড়েচড়ে পিছনের দিকে তাকাতে অর্চনা মাকে বাবার আড়াল করে ইশারায় বলতে চাইল, আর বসে কেন, নামুন।
ননিমাধব বীরের মতই নেমে পড়ল।
তারা দুজন গাড়ির ও-পাশ থেকে ঠেলছে। অর্থাৎ মিসেস বাসুর দিক থেকে। পিছনে কুলি দুজন–এ-পাশে সুখেন্দ। অর্চনা মহা আনন্দে একবার তাকে আর একবার স-পার্টনার দাদাকে দেখছে। ডক্টর বাসু উৎফুল্ল হাতে স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকাতেই মিসেস বাসু সরোষে রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেদিক থেকে একটা চলন্ত লরী একেবারে চান করিয়ে দিয়ে গেল বিজন আর ননিমাধবকে। জলের ঝাপটা বাঁচাতে গিয়ে মিসেস বাসু স্বামীর গায়ের ওপর এসে পড়লেন।
ওদিকে কিম্ভুতকিমাকার অবস্থা বিজন আর ননিমাধবের।
.
সারাপথ মিসেস বাসু রাগে গজগজ করতে করতে যে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, তাই ফলল।
সেই থেকে বিজনের হাঁচি, কাসি আর অরভাব। একবার গাৰ্গলের জন্য তিনবার করে গরম জল করতে করতে দাও মহাবিরক্ত। গা-হাত-পা টেপা আর নভেল পড়া দুটোই একসঙ্গে করতে গিয়ে রাণু দেবীও অনেকবার ধমক খেয়েছে। তার হাঁচির দমকে দাশুর হাতের গ্লাস থেকে ক-বার গরম জল চলকে পড়েছে ঠিক নেই। হাঁচির ভয়ে অতঃপর সন্তর্পণেই ঘরে, ঢুকেছে সে।
বিজন তিক্তবিরক্ত।–কি ওটা?
গরম জল।
ফেলে দে।
নভেলের আশা বিসর্জন দিয়ে রাণু দেবী ভয়ে ভয়ে দু-হাত লাগিয়েছেন। ফেলে দেবে কেন, গরম জল খাবে যে বললে?
তুমি উপন্যাস পড়ো!… দাশুর ওপরেই মেজাজ ফলিয়েছে, এই–ওটা রেখে টেপ এসে। গা হাত-পা গেল, কোথাকার কে একটা থার্ডক্লাস লোক, সে বলল আর একগলা জলে নেমে গাড়ি ঠেলো!
যার কথায় একগলা জলে নেমে গাড়ি ঠেলা তাকেও খুব রেহাই দেননি তার গৃহিণীটি। নিরুপায় মুখে ডক্টর বাসু বসে বসে চুরুট টেনেছেন আর স্ত্রীর তর্জন এনেছেন। এর ওপর ননিমাধবেরও জ্বর হয়েছে শুনে নতুন করে আর এক দফা শোনাতে বসলেন তিনি। তোমার জন্যে, শুধু তোমার জন্যে, বুঝলে? তিনদিন ধরে বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছে ছেলেটা, ওদিকে ননিমাধবও জ্বরে পড়েছে–কে না কে বলল আর অমনি হুট করে ছেলে দুটোকে তুমি জলে নামিয়ে দিলে! ওরা কি করেছে এসব কোনদিন?
ডক্টর বাসুও শেষে বিরক্ত হয়েই পাল্টা জবাব দিয়েছেন, জ্বর হয়েছে সেরে যাবে। আমি ভাবছি আমাদের জন্য ওই পরের ছেলেটির আবার অসুখ-বিসুখ করল কিনা। কি ঠিকানাটা বলেছিল, ড্রাইভারকে একবার পাঠিয়ে দাও না খবর নিয়ে আসুক।