অকূলে কূল পেয়েছে, মায়ের সাজসজ্জার দিকে চোখ গেছে। তাড়াতাড়ি কাছে এসে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করেছে, বাঃ, কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে মা বেরুচ্ছ নাকি?
মুশকিল আসান। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে তাড়া দেওয়ার কথাটাই মনে পড়েছে তাঁর। আর প্রীতও একটু হয়েছেন।–থাক, তাড়াতাড়ি নিজে একটু সুন্দর হয়ে নে–মিতার ওখানে পাঁচটায় যাব কথা দিয়েছি, পাঁচটা তো এখানেই বাজল!
তক্ষুণি রেডি হবার উৎসাহে অৰ্চনা পালিয়ে বেঁচেছিল। কেন মরতে চেনাতে গিয়েছিল বাবাকে ভেবে সেই লোকটার ওপরেই রাগ হচ্ছিল তার।
ডক্টর বাসু সেদিন অর্চনার মুখে শুনে স্মরণ করতে না পারলেও লোকটিকে চিনতেন যে খুবই সেটা এমন করে প্রকাশ হবে অর্চনা ভাবেনি।
এমন মজার ব্যাপার আর হয় না যেন।
কলকাতা শহরে জল হয়, জল হলে অনেক রাস্তা জলমগ্ন হয়, আর তখন অনেক রাস্তার মাঝখানেই যানবাহন অচল হয়। সেই অবস্থায় পড়লে অনেকেরই মেজাজ বিগড়োয়। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে বিধাতার চক্রান্ত সম্বন্ধে অথবা রাস্তাঘাটের দুরাবস্থার সম্বন্ধে তিক্ত অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু লজ্জায় কারো মাথা কাটা যায় না বোধহয়।
মিসেস বার সেদিন লজ্জায় মাথা কাটাই গিয়েছিল। তাঁদের গাড়িটা যে নতুন নয় সেই দুর্বলতা আর ক্ষোভ ছিল বলেই তার মনে হয়েছে, পথচারীরা পুরনো গাড়ির অচল অবস্থা দেখে মনে মনে হাসছে। তার ধারণা, শুধু ড্রাইভারের কাণ্ড জ্ঞানহীনতার ফলেই এই দুর্ভোগ। তাই প্রথম অসহিষ্ণুতার ঝড়টা সেই বেচারার ওপর দিয়েই গেল।
গাড়ির দু-ধারে বসে অর্চনা আর তার মা। মাঝখানে বাবা। সামনে বিজন আর ননিমাধব। ছুটির দিনে মার্কেট থেকে ফেরার পথে এই বিড়ম্বনা।
রাস্তা জলে থৈ থৈ। দূরে দূরে আরো দুই একটা মোটর আটকেছে। এই গাড়ির চাকা এখনো অর্ধেকের বেশি জলের নিচে। জল এখনো টিপটিপ করে পড়ছে, কিন্তু গাড়ি নড়ে না। ড্রাইভার বিরস বদনে বনেট খুলে টুকটাক তদারক করে এসেও গাড়ি নড়াতে পারল না। অর্চনা ভয়ে ভয়ে এক-একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে, ড্রাইভারের কপালে আজ আরো কিছু আছে।
মিসেস বাসু ঝাঁজিয়ে উঠলেন, গাড়ি চলবে না? এভাবেই তাহলে বসে থাকি সমস্ত দিন? এ রাস্তেমে তুমকো কোন্ আনে বোল?
সুপারিশের আশায় ভিজে চুপসানো অবস্থায় বেচারা ড্রাইভার বিজনের দিকে তাকাল। কিন্তু তারও মুখে রাজ্যের বিরক্তি। শুধু ননিমাধবেরই বোধহয় খারাপ লাগছে না খুব, কিন্তু মুখভাবে সেটা প্রকাশ করার নয়।
স্ত্রীর কোপ থেকে ড্রাইভারকে আগলাতে চেষ্টা করলেন ডক্টর বাসু। বললেন, ওকে বকছ কেন সেই থেকে, ও কি করে জানবে এরই মধ্যে এখানে এতটা জল জমে গেছে।
তুমি থামো।…উন্টে মেজাজ আরো চড়ানো হল তার ড্রাইভারি করছে আর ও জানবে না জল হলে কতটা জল জমে এখানে! তুমি আর তোমার ওই ড্রাইভারই জান না, আর সকলেই জানে। ড্রাইভারের উদ্দেশে ধমকে উঠলেন, দেখতা কেয়া? আদমী বোলাও!
অসীম বিরক্তিতে নিজেই ফুটপাথের দিকে চেয়ে হাঁক দিলেন, কুলি, কুলি
মহিলাটি যেখানে উপস্থিত, গাড়িতে আর সকলেরই সেখানে প্রায় নীরব দর্শকের ভূমিকা। দাদা আর তার পাশের মূর্তিটির ওপরেই বেশি রাগ হচ্ছে অর্চনার। একটা ব্যবস্থা কিছু করলেও তো পারে। মায়ের উগ্র কণ্ঠস্বরে রাস্তার লোকগুলোও যে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে।
শুধু রাস্তার লোকগুলোই নয়, আর একজনও ফিরে তাকিয়েছে। আধ ভেজা অবস্থায় ওদিকের গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্চনা হঠাৎ খুশীও, আবার অপ্রস্তুতও।
সুখেন্দু মিত্র তাদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। অর্চনা হাসতে গিয়েও মায়ের মূর্তি স্মরণ করে থমকে গেল। তাড়াতাড়ি বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে।
বাবা–
আঙুল দিয়ে বাইরের আগন্তুকটিকে দেখিয়ে দিল। জলের ওপর দিয়েই। জুতোসুদ্ধ পা চালিয়ে গাড়ির দিকে আসছে সে। মিসেস বাসু অপ্রসন্ন স্বগতোক্তি করে উঠলেন, লজ্জায় মাথা কাটা গেল!
গাড়ির কাছে এসে সুখেন্দু মিত্র সকলের উদ্দেশেই দু-হাত জুড়ে নমস্কার জানাল। প্রতিনমস্কারের জন্য হাত তুলতে গিয়েও ডক্টর বাসু বিস্মিত নেত্রে তাকালেন তার দিকে। চিনতে চেষ্টা করলেন।–আপনি, তুমি, তুমি সুখেন্দু না?
হ্যাঁ স্যর।
খুশির আতিশয্যে ডক্টর বাসু মেয়েকে বললেন, সেদিন তুই সুখেন্দুর কথা বলছিলি? ওকে চিনব না, কি কাণ্ড …।
যেন অর্চনাই দোষী।
কিন্তু তুমি দাঁড়িয়ে ভিজছ যে!
সুখেন্দু বলল, আমি আগেই ভিজেছি–।
সামনের সীটের দুজনও ঘাড় ফিরিয়েছে। পরম উৎসাহে স্ত্রীর দিকে তাকালেন ডক্টর বাসু।–তোমার মনে নেই, সে যে একবার ছেলেগুলো স্ট্রাইক করেছিল জোট বেঁধে, আমি চাকরি রিজাইন করতে যাচ্ছিলাম–এই সুখেই তো সব দিক সামলালে। ভুলে গেছ? কি বিপদেই পড়েছিলাম…
মিসেস বাসুর বিগত বিপদ স্মরণ করার কোন বাসনা নেই। চাপা রাগে বললেন, এখন জলে পড়ে আছ-তোমার এই ড্রাইভার দিয়ে আর চলবে না।
দোষটা যে গাড়ির নয়, ড্রাইভারের, সেটাই শোনালেন কিনা তিনিই জানেন।
ডক্টর বাসু বস্তুজগতে ফিরলেন। বিব্রতমুখে হাসতেই চেষ্টা করলেন, ও হ্যাঁ, কি মুশকিল দেখ, ড্রাইভার আবার . ইনি আমার স্ত্রী।
সুখেন্দু জানাল, সেদিন ছাত্রের বাড়িতে তাকে দেখেছিল। কিন্তু মিসেস বাসু শুনলেন না বোধ হয়, ড্রাইভারের খোঁজেই তার উষ্ণ দৃষ্টি অন্যত্র প্রসারিত।